পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এবারে আধা সামরিক বাহিনী একটা মস্ত বড় রাজনৈতিক বিবাদ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের নির্দেশের পক্ষেই রায় দেওয়ায় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করাটা অসম্ভবই হয়ে গিয়েছে। এই রায়ে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছে। এই আনন্দে বিজেপি মশগুল। বিজেপি এখন মনে করছে, এটা তাদের একটা মস্ত বড় রাজনৈতিক জয়।
আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন কিন্তু এর আগে বেশ কয়েকটি নির্বাচনেই হয়েছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে। কিন্তু আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের আগে এটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে আধা সামরিক বাহিনী মানেটা কী। সেনাবাহিনী নয়, তার অধীনে আধা সামরিক বাহিনী। যাকে ইংরেজিতে বলা যেতে পারে প্যারা মিলিটারি ফোর্স। কেন্দ্রীয় বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। যে রকম সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীন। এই প্যারামিলিটারি ফোর্স বা আধা সামরিক বাহিনী শুধুমাত্র সিআরপিএফ নয়, অসম রাইফেলস থেকে শুরু করে এমনকী অনেকে জানে না এসপিজি অর্থাৎ স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপ, যারা প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের পরিবারের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন, তারাও কিন্তু আধা সামরিক বাহিনীর অধীনেই পড়ে।
আধা সামরিক বাহিনী এসপিজির সব থেকে ছোটো আধা সামরিক বাহিনী। তিন হাজারের মতো কর্মী আছে। আবার বিএসএফ একটা মস্ত বড় প্রতিষ্ঠান। সীমান্তে পাহারা দেওয়াটা তাদের বড় কাজ। সিআইএসএফ অর্থাৎ সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স, তারা বিমানবন্দর এবং শিল্প ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।
আধা সামরিক বাহিনীকে ভোটের কাজে লাগানো অগ্রাধিকার ছিল না, এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এটা করা হয়েছে। এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধিতা করছেন সেটা শুধুমাত্র আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করাটা নয়, মূল প্রশ্ন ছিল, একটা 'ফেডেরেলিজম' বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা স্টেট সাবজেক্ট। পুলিশ রাজ্য সরকারের অধীনে। পঞ্চায়েত নির্বাচনটা কখনওই কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচনের অধীনে হয় না। স্টেট নির্বাচন আধিকারিকের অধীনে হয়। মূলত রাজ্য প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসাররা এই নির্বাচনটা পরিচালনা করেন। এটাই গণতন্ত্রের একটা মস্ত বড় নজির।
ত্রিস্তরের পঞ্চায়েত সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিপিএম জমানায়। তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের নির্বাচনে সন্ত্রাস দেখা গিয়েছে। এখন আধা সামরিক বাহিনী পাঠালেই কি পঞ্চায়েতের সন্ত্রাস থেমে যাবে? সেটাও একটা মস্ত বড় প্রশ্ন। আধা সামরিক বাহিনী কতটা পাঠানো হবে, কোথায় পাঠানো হবে সেগুলো তো রাজ্য সরকারের মাধ্যমেই ঠিক করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বলতেই পারে যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যখন বলা হয়েছে, আধা সামরিক বাহিনী পাঠানো হবে তবে বেশ, পাঠানো হোক। এক ব্যাটেলিয়ান পাঠাও দুই ব্যাটেলিয়ান পাঠাও। কিন্তু আবার বিজেপি বিরোধীদল হিসেবে বলতে পারে, এত কম ব্যাটেলিয়ান পাঠালে হবে না। এত বড় একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে এত পঞ্চায়েতের প্রার্থী এত হাজার হাজার প্রার্থীর নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হবে। ইতিমধ্যেই ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরও কত হত্যা হবে। সেই হত্যা হবে বলে অপেক্ষা না করে এখনই আধা সামরিক বাহিনী পাঠানো হোক। কিন্তু এখানে রাজ্য সরকারের যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, এই নাক গলানোটা কেন্দ্র করতে পারে কিনা।
আবার দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হল, আধা সামরিক বাহিনী মণিপুরেও প্রয়োজন হচ্ছে। এখন মণিপুরে ২০০ জন লোক মারা গেছে। এখন সেখান থেকে কি আধা সামরিক বাহিনীকে তুলে এনে পশ্চিমবঙ্গে বসানো হবে! ২০২১ এ একটা জিনিস লক্ষ্য করা হয়েছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই রকমই আধা সামরিক বাহিনী পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছে যারা পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সেইসব আধা সামরিক বাহিনীর কর্মীরা যারা পশ্চিমবঙ্গের টপোগ্রাফিটা জানে। এখন সেই রকম পাওয়াটাও কঠিন। পেলেও তাদেরকে পাঠানো মানে তাদের একটা বিরাট খরচ আছে। ট্রেনে করে পাঠানো হবে নাকি বিমানে করে পাঠানো হতে পারে। ২০২১ সালে আগাম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আধা সামরিক বাহিনীকে। তারা ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল, সাত দিন মিছিল করেছিল। জেলা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেও বোঝার চেষ্টা করেছিল স্থান সম্পর্কে। এটা সত্বেও কিন্তু তাদের নির্ভর করতে হয় জেলা পুলিশ, রাজ্য পুলিশের উপর। সুতরাং আধা সামরিক বাহিনী যতই পাঠানো হোক সে ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশের ভূমিকা অটুট থাকছে।
এখানে মূল প্রশ্নটা হল, আধা সামরিক বাহিনী পাঠালেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? সন্ত্রাস কি থেমে যাবে? আমার কিন্তু মনে হয় না। আধা সামরিক বাহিনীর এই বিষয়টা একটি রাজনৈতিক বিতর্ক। কে কতটা রাজনৈতিক ফসল তুলতে পারে সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু আধা সামরিক বাহিনী একটা বটিকা নয় যে এটা সেবন করিলেই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতের সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে যাবে এবং ভোট হিংসা মুক্ত হয়ে যাবে।