তিনি দুর্ঘটনাগ্রস্তদের দুর্গতনাশিনী। তিনি হলেন শান্তি রাই। মানুষের মুখে মুখে তিস্তা কন্যা ও iron lady of Darjeeling নামে পরিচিত। মানুষের জীবন বাঁচিয়েই শান্তি মেলে তার মনে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি তিস্তা বরাবরই ভয়ঙ্কর। তিস্তা নদীর খাদে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বহু গাড়ি পড়ে যায়। মানুষের দেহ পেতে হিমশিম খায় প্রশাসন। তাঁরা শান্তির কাছে দ্বারস্থ হতেন। হতাহতদের উদ্ধার থেকে নিয়ে মৃত দেহকে খুঁজে বের করার কাজে শান্তির ভূমিকা অতুলনীয়। এক কথায় ইনি আমাদের দেশের অনন্যা। প্রবল তিস্তার জলস্রোত হোক কিংবা অন্য কোন নদী উদ্ধারকার্যে আজও তিনি পথ দেখাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে স্থানীয় যুবক-যুবতীদের একত্রিত করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। বিপদগ্রস্তদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া পাহাড়ের বিভিন্ন মহল তাকে জলপরী থেকে শুরু করে আয়রন লেডি অফ দার্জিলিং ইত্যাদি তকমাও দিয়েছে। তিনি তিস্তা কন্যা - বা তিস্তা কুইন 'শান্তি রাই '।
তিনি কালিম্পং জেলার দশমাইলের রংপোর তারখোলা এলাকার মানগচুর স্থায়ী বাসিন্দা। রাফটিং হোক কিংবা বন্যা বা প্রবল জলস্রোত সাথে পাঞ্জা কষে উদ্ধারকাজ সবেতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রত্যন্ত পাহাড়ি বনগ্রাম থেকে উঠে আসা পাহাড়ি কন্যা উদ্যোগকে এখন কুর্ণিশ জানাই সমস্ত মহলই।ইতিমধ্যে বহু দুর্ঘটনাগ্রস্তদের দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে তিনি প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তাছাড়া দুর্ঘটনার পর গাড়ি কিংবা মৃতদেহ উদ্ধারের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়।
প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার থেকে প্রাদ প্রদীপের আলোর বৃত্তের বাইরে শান্তির নিরলস প্রচেষ্টার বহু বছর ধরেই চলছে। শান্তির বাবা প্রয়াত সুন্দর রাই , মা গৃহবধূ বৈষ্ণমায়া রাই। পাঁচ ভাই দুই বোনের বেড়ে ওঠা। পাহাড় থেকে নেমে আসা তিস্তার প্রবল জলস্রোতের সাথে শৈশব থেকেই সখ্যতা শান্তিকে সুদৃঢ় ও জীবন সংগ্রামের পাঠ দিয়েছে।
মেয়েবেলা থেকেই খেলাধুলা এবং সাঁতারের সহজাত দক্ষতা পাঠ দিয়েছিল দাদা প্রবীণ রাই এবং সন্তবীর লামার কাছে র্যাফটিংয়ের হাতেখড়ি।পরবর্তীতে ফুটবল খেলা, রাফটিং, সাঁতার পাহাড়ে চড়া অন্যান্য খেলাধুলা এবং প্রতিযোগিতায় বরাবর সাফল্য পেয়েছেন। এর জন্য জীবনের চলার পথে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছ থেকে স্বীকৃতি মিলেছে। ২০০৩ সালে হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং প্রতিযোগিতা, ২০১২ ও ২০১৩ সালে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাহাড়ে চড়ার স্বীকৃতি মেলে। যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া দপ্তর এবং পুলিশ বিভাগের হিমালায়ান তরাই ডুয়ার্স স্পোর্টস ফেস্টিভ্যালে ফুটবলে সহ বিভিন্ন সাফল্য রয়েছে তার ঝুলিতে।
কার্যত অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে প্রথাগত খেলাধুলার জগতে তিনি বহুমুখী প্রতিভা। তবে পাহাড়ি কন্যা শান্তিকে কেবলমাত্র তার সাফল্যের খতিয়ান দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। বহু বছর পূর্বেই শান্তি দেখেছিলেন পাহাড়ের খাদের গড়িয়ে পড়ে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে কত মানুষ ও যানবাহন। সে সময় তাঁর মন বলত নিজেকে প্রশিক্ষিত করে উদ্ধারকারী হওয়ায়। মন প্রাণে জীবন সংগ্রামকে হাতিয়ার করে তুলেছেন তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন।
পাশাপাশি পথ দেখিয়েছেন অন্যদেরও। স্থানীয় যুবক-যুবতীদের ও সমাজসেবা পথ দেখাচ্ছেন। বছর তিন পূর্বে স্থানীয় যুবক-যুবতীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন তিস্তা রঙ্গিত রেসকিউ সেন্টার নামে সমাজসেবী সংস্থা । কোথাও উদ্ধারকাজের প্রয়োজন পড়লেই টীম শান্তি ছুটে যায়। মানুষের পাশে দাঁড়ান শুরুটা হয়েছিল অনেক দিন পূর্বেই।
শান্তির কথায় ১৬ বছর বয়স থেকেই আমি উদ্ধার কাজের সাথে যুক্ত। ২০০৫ সালে আমি সিকিমের মল্লি গিয়েছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম পাহাড়ের খাদের একটি গাড়ি পড়ে গেছে। শুধুমাত্র দড়ি বেঁধে উদ্ধারকাজে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। সেবার চার জনকে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম । তার মধ্যে একজন মহিলা ও শিশুও ছিল। মানুষকে বাঁচানোর আমাকে তৃপ্তি দিয়েছিল। তারপর থেকে এ কাজকেই আঁকড়ে ধরেছি। ২০০৮ সালে বিহারের সুনকোষ নদীতে বন্যায় অনেক মানুষকে উদ্ধার করতে অংশ নিয়েছিলাম। পরে রম্ভির তিস্তার লো ড্যাম প্রকল্পেও জলোচ্ছ্বাসে দুই শতাধিক বাসিন্দাদের উদ্ধারে হাত লাগিয়ে ছিলাম। এরপর এ কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরেই।
বর্তমানে শান্তির রাফটিং খেলাধুলার পাশাপাশি কুড়ি জন মহিলাকে নিবিড় ফুটবল প্রশিক্ষণও দেন। সমস্যা সত্ত্বেও তিনি এগিয়ে যেতে চান। শান্তির কাছে থাকা বোটটি পুরনো। সংস্কার প্রয়োজন অথবা নতুন বোট দরকার। দুর্ঘটনাগ্রস্ত স্থানে উদ্ধারকার্য করে ফিরে আসার জন্য নিজস্ব একটি গাড়ি প্রয়োজন। পূর্বে একজনের উপহার দেওয়া পুরনো গাড়ি ছিল। বর্তমানে সরাসরি তার হেফাজতে সেই গাড়ি নেই। ফলে দুর্গম এলাকাতে উদ্ধারকার্যে গেলে রাত বিরেতে ফিরে আসা নিয়েও দুশ্চিন্তা থাকে। তিনি জি টি এ র পর্যটন বিভাগের আওতায় মহিলা নদী গাইড হিসেবে কাজ করেন। শান্তির বক্তব্য অনুযায়ী উত্তরবঙ্গে এ ধরনের পদে কেবলমাত্র তিনিই কর্মরত রয়েছেন।
সমস্যা সত্বেও শান্তি আজ যেন এক আলোকবর্তিকা। সিকিম, দার্জিলিং কালিম্পং সহ বিভিন্ন মহল থেকে তার উদ্যোগকে স্বীকৃতিও জানানো হয়েছে। বর্তমানে শান্তিরা নিজস্ব সংস্থা তিস্তা রঙ্গীত রেস্কিউ সেন্টার এর সদস্য সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। শান্তি নিজে এই সংস্থার সভানেত্রী পদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সমস্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে নতুন আলোর পথ দেখাচ্ছে তার সঙ্গে থাকা পাহাড়ের যুবক-যুবতীদের। শান্তির সহযোগী সেংডুপ শেরপা বলেন আমরা ডুব সাঁতার দিয়ে পাহাড়ি নদীর থেকেও গাড়ি উদ্ধারের কাজ চালাই। আমাদের কাছে শান্তি রাই অনুপ্রেরণার। কালিম্পং জেলা প্রশাসনের বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগ সূত্রেই জানা গেছে শান্তি এবং তাদের সহযোগীরা যখন প্রয়োজন পড়ে তিনি তখনই উদ্ধারকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এ ধরনের উদ্যোগকে কুর্নিশ জানিয়েছে জানিয়েছে পরিবেশ প্রেমী মহল থেকে শুরু করে রাজ্যের মন্ত্রীও। পরিবেশ প্রেমী সংস্থা হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন( ন্যাফ) র প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অনিমেষ বসু বলেন, শান্তি রাইদের মতন পাহাড়ি কন্যারা পথ দেখাচ্ছেন। এক সময় বহু বছর পূর্বে আমরাও উদ্ধারকার্য করতাম। বর্তমানে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য বিশেষ টিম ও বিভাগ রয়েছে। তবুও পাহাড়ের উদ্ধারকার্যে সহজাত দক্ষতার থাকার জন্য শান্তি রাইদের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ এবং আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বুলু চিক বড়াইক বলেন ,আমরা পাহাড়ি মহিলা শান্তি রাই এবং তার সহযোগীদের কাজকে সাধুবাদ জানাই। আমি প্রশাসনিক মহল থেকে ওঁদের কোনও রকম সহযোগিতা করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।