পাকিস্তান সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সেই মুহূর্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অর্থাৎ আজকের দিনেই ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি সেনা। ভারতের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর পাকিস্তান সরকারের নেতৃত্বে হামুদুর রহমান কমিশন গঠিত হয়। যুদ্ধে হারের কারণ কী, সেটাই ছিল এই কমিশনের অনুসন্ধানের প্রধান বিষয়। সেই তদন্তের রিপোর্টও সামনে আসে। তাতে বলা হয়েছিল, মদ-নারীদের প্রতি উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের আসক্তি ও পচে যাওয়া শাসন ব্যবস্থা যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্থান ঢাকার রমনা রেসকোর্স। সূর্য ডুবছে। সন্ধে যেন অন্ধকার মাখছে। ঠিক তখন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি মুখ নামিয়ে বসে আছেন চেয়ারে। সামনে রাখা টেবিলে তাঁর হাতিয়ার। যা আগেই আত্মসমর্পণ করেছেন। পিছনে দাঁড়িয়ে ৯০ হাজারেরও বেশি সেনাকর্মী। সবাই পাকিস্তানের। সবাই আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতের কাছে এমন পরাজয়ের পর নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতবড় সামরিক আত্মসমর্পণ পৃথিবী দেখেনি। আর নিয়াজির সামনে বসে ভারতীয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। তিনি অর্ডারের অপেক্ষা করছেন।
যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী তখনও ক্ষেপে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর। তারাও সেনা ক্য়াম্পের বাইরে দাঁড়িয়ে। প্রতিশোধ নিতে চায় আরও। কারণ এতদিন ধরে এই পাক সেনারাই তো তাদের মা-বোনের ইজ্জত লুটেছে। নির্বিচারে হত্যালীলা ঘটিয়েছে। আজ তাদের অহঙ্কার মাটিতে মিশেছে। তাই শেষ হিসাব বুঝে নিতে চায় বাংলাদেশের যোদ্ধারা।
পাকিস্তান সেনার অহঙ্কার এভাবে যখন বাংলাদশের মাটিতে মিশছে, ভারতীয় জওয়ানদের সামনে আত্মসমর্পণ করছে, তখন রাওয়ালপিন্ডিতে বসে মদ্যপান করছেন পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক ও সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খান। তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন জেনারেল রানি। তিনি বা প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে সাক্ষ দেন, যেদিন ভারতের কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তান, সেদিন রাতেও মদ ও মহিলাদের নিয়ে ফূর্তি করছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
কিন্তু এটাও কি সম্ভব? জাতির দুর্দিনেও কি একজন নেতা- জেনারেল-সর্বাধিনায়ক এই কাজ করতে পারেন? উত্তর হল, পাকিস্তানের যে তদন্ত কমিশন বসেছিল, তাদের তরফেই পরে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তানের হারের কারণ এমন ছিল যা প্রকাশ্যে হয়তো বলাও যাবে না।
ইয়াহিয়া খান : একজন আদ্যোপান্ত মাতাল
জেনারেল আগা মুহম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। নিজেকে পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে ক্ষমতায় বসেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন। তবে তা তো করেনই পরিবর্তে পাকিস্তানে আরও অরাজকতা শুরু হয়। উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে মদের আসর বসাতে শুরু করেন।
তবে ইয়াহিয়াকে ভয় পেতেন পাকিস্তানের আধিকারিক ও আম আদমি। কারণ ১৯৭১ সালে মুজিবুর রহমানের দলের জেতার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চরম অত্যাচার শুরু করেন এই ইয়াহিয়া। ফলে তিনি কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। যুদ্ধ পরবর্তী কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ইয়াহিয়া পাকিস্তান সরকারে ও সেনার মধ্যে এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন মাতাল ও দুর্নীতি পরায়ণ। কমিশনকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, ঢাকা থেকে একের পর এক তারবার্তা আসার পর, পাকিস্তানের হার নিশ্চিত জানার পরও সামরিক কর্মকর্তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ কমান্ডার-ইন-চিফ (ইয়াহিয়া) নাকি অসুস্থ। অর্থাৎ তিনি যে মদের নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কমিশন এও জানিয়েছিল, ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা ব্যক্তিই যদি এমন হন তাহলে দেশ পতনের দিকে যাবেই, সেটাই তো স্বাভাবিক!
জেনারেল রানি- বিছানারও ক্ষমতা থাকে!
হ্য়াঁ ঠিকই পড়ছেন। পাকিস্তানের যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলা হয়েছিল, একজন মহিলা ও তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার। নাম আকলিম আখতার। ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন তিনি। এতটাই ঘনিষ্ঠ যে তাঁকে জেনারেলের রানি বলা হতো। ছিলেনও তাই। সরকারিভাবে ইয়াহিয়ার স্ত্রী ছিলেন না বলে শোনা যায়। তিনি বিয়ে করেছিলেন অন্য পুরুষকে। কিন্তু ঘর করতেন পাকিস্তানের সর্বাধিনায়কের সঙ্গে।
কমিশন তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, এই সুন্দরী, লাস্যময়ী আকলিমের জন্য ইয়াহিয়ার দ্বার ছিল অবারিত। কোনও সরকারি পদের অধিকারী না হলেও সেনাক্যাম্প থেকে বেডরুম, সব জায়গায় যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রেমে ইয়াহিয়া এতটাই ডুবেছিলেন যে, সব সিদ্ধান্তও নিজে নিতেন না। ছেড়ে দিতেন ওই মহিলার উপর।
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ যখন চলছে তখনও গোটা পাকিস্তানের ভাগ্য নাকি নির্ধারণ করতেই ওই মহিলা। সরকারি সিদ্ধান্ত, সেনাদের রণকৌশলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন। আর তাঁর কথার উপর টুঁ শব্দ করার সাহস ছিল না কারও! তিনি যে জেনারেলের রানি!
হামুদুর রহমান কমিশন পরে জানায়, পাকিস্তানের এই হারের অন্যতম কারণই ছিল ইয়াহিয়া খানের বিশৃঙ্খল জীবন-যাপন। যার নেপথ্য়ে ছিলেন আকলিম। তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক কীভাবে পাকিস্তানের ভাগ্যকে বিপর্যস্ত করেছিল, তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে। যদিও সেই রিপোর্টে কারও নাম করা হয়নি। তবে তা বুঝতে বাকি থাকেনি। যাকে জেনারেলের রানি বলা হত, সেই মহিলা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ঘৃণার পাত্রী হয়ে ওঠেন।
নুরজাহান : যুদ্ধের সময়ের একজন গায়িকা
কমিশন তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, পাকিস্তানের হারের অন্যতম কারণ ছিল বিনোদন। আদেশের চেয়ে নাচ-গান-মদে বেশি সময় খরচ করতেন আধিকারিকরা। আর সেই আসরের মধ্যমণি ছিলেন নুরজাহান। তিনিই জেনারেল ইয়াহিয়াকে মাতিয়ে রাখতেন।
আসলে অবিভক্ত ভারতে গ্রামোফোনের জগতে নুরজাহান ছিলেন বিখ্যাত গায়িকা। দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানকে বেছে নেন। তাঁকে বলা হত মেলোডি কুইন। দেশভাগের সময় তিনি পাকিস্তানে গানের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে যা করেছিলেন, তা পাকিস্তানের ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়।
যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সৈন্য যখন হারের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন এই নুরজাহানই রেডিওতে পাক বাহিনীর জয় ও বিজয় উৎসবের ঘোষণা করেন। এমনকী প্রশাসনকে তাঁর গান রেডিওতে বাজানোর জন্যও বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু পরে জানা যায় পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে।
তদন্তে নেমে কমিশন জানতে পারে নুরজাহান যু্দ্ধকালীন সময়ে থাকতেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। তাঁরই বাসভবনে। সুতরাং নিজের নাম প্রচারের জন্যই যে ইয়াহিয়ার মদ্যপ থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিলেন ওই গায়িকা, তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।
নিয়াজি : কমান্ডার হলেও কমান্ড দিতে পারেননি
পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার ছিলেন নিয়াজি। অর্থাৎ যুদ্ধ ঘোষণার পর সেই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারক ছিলেন তিনি। অথচ হামুদুর রহমান কমিশন তদন্তে জানতে পারে নিয়াজি কমান্ডার হিসেবে যোগ্য ছিলেন না। কারণ, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন এতটাই বিশৃঙ্খল ছিল যে, এতবড় দায়িত্ব সামলানোর মতো বুকের পাটা দেখাতে পারেননি।
মহিলাদের উপর নিজে যৌন নির্যাতন করতেন তিনি। আর সেটা এই মাত্রায় যে নিজের অফিসাররা বিরক্ত ছিলেন তাঁর প্রতি। নির্দেশ মানতেন না। লাহোরের গুলবার্গের একজন সাইদা বুখারি নামে একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল নিয়াজির। বিখারি একটি পতিতালয় পরিচালনা করত। সেখানেও যাওয়া আসা ছিল কমান্ডারের। এমনকী ঘুষও নিতেন। তাঁর অধস্ত্ন কর্মীরা নাকি বলাবলি করতেন, 'কমান্ডার তো নিজেই ধর্ষক। তাহলে আমরা কেন থামব?'
রিপোর্টে এও দাবি করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে ভারত আক্রমণ করার সময় নিয়াজির সেনাবাহিনীর লড়ার মতো ক্ষমতা ছিল না। কারণ, ঘুণ আগে থেকেই ধরেছিল। ফলে হামলার সঙ্গে সঙ্গে কোনও প্রতিরোধ ছাড়া তারা আত্মসমর্পণ করে।
নৈতিক পতনের তত্ত্ব
হামুদুর রহমান কমিশন তাদের রিপোর্টের উপসংহারে জানিয়েছিল, পাকিস্তানের এমন হারের কারণ রাজনৈতিক নয় বরং নেতিক দেওলিয়াপনা। যুদ্ধ কৌশল নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরিবর্তে কর্মকর্তারা মদ ও মহিলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সরকারি টাকার অপচয় করতেন। জওয়ানরা আরাম ও আয়েশে জীবন যাপন করতেন। ক্ষমতা, টাকা, নারী ও যৌনতা-এই ছিল তাদের সঙ্গী।
হারের পর ইয়াহিয়া ও নিয়াজির পতন
১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। পরাজয়ের পরপরই ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতি এবং সেনাবাহিনীর কমান্ড পদ থেকে সরে দাঁড়ান। পাকিস্তানে প্রবল জনরোষের মধ্যে ক্ষমতায় বসেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। তিনি বন্দী করেন প্রাক্তনকে। তবে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। রাজসাক্ষী করা হয়েছিল সরকারের তরফে।
১৯৭০-এর দশকের বেশিরভাগ সময় অভ্যন্তরীণ কারাগারে ছিলেন ইয়াহিয়াকে। একজন অপমানিত প্রাক্তন শাসক হিসেবে শেষ বছরগুলি কাটিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে মারা যান।
এদিকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানে ফেরার পর তিনি সেনাবাহিনী থেকে ব অবসর নেন। কেড়ে নেওয়া হয় পদক ও সম্মান।
যদিও নিয়াজি নিজেকে দোষী মানতে নারাজ ছিলেন। তাঁকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে, এমনটাই দাবি ছিল তাঁর। কিছু সময়ের জন্য রাজনৈতিকভাবেও সক্রিয় ছিলেন। 'দ্য বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান' নামে একটি বইও আছে তাঁর। ২০০৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে মারা যান।
কমিশন বসেছিল কিন্তু পরিণাম সেই পরিহাস
কমিশন তাদের রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে জওয়ান, সেনাকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল। প্রমাণ দিয়েছিল। তবে তা কখনও প্রকাশ্যে আলোচনা করা হয়নি। কোনও কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনার কথাও ভাবেনি সরকার। ফলে রিপোর্ট কয়েক দশকের মধ্যেই চাপা পড়ে যায়।