
সিপিএমের বর্ষিয়ান নেতা বিমান বসু অবসর নিলেন। পলিটব্যুরো থেকেও তিনি সরে দাঁড়ালেন। বয়সের জন্য সরে দাঁড়ানো এটা পার্টির সিদ্ধান্ত। কিন্তু অনেকদিন থেকেই বিমানবাবু সরে যেতে চাইছিলেন। বিমান বাবুর এখন বয়স ৮২ বছর। বিমানবাবু যে খুব অসুস্থ এমনটা কি বলা যায়? এখনও কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে বিমানবাবুকে মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায়। অকৃতদার,পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, সৎ কমিউনিস্ট বলে পরিচিত বিমান বসু। তাঁর অবসর নেওয়া মানে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে একটা যুগেরও অবসর গ্রহণ।
বিমানদা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছাদে থাকেন একটা ছোট্ট ঘরে একথা এখন প্রায় সকলেই জানেন। কার্যত একজন সন্ন্যাসীর মতো জীবন। আমি তো রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সন্ন্যাসী আর বিমানদার জীবনের মধ্যে খুব একটা তফাৎ দেখি না। ছাদে অনেক গাছ-টাছ আছে। সেই গাছগুলি খুব যত্ন করে পালন করেন। রোজ গাছে জল দেন। শুধু ফুলের টব নয়, প্রচুর শাকসবজিও ফলান। এমনকী রীতিমতো ফুলকপি হয়,বেগুন হয়। একটা সময় বেশ মনে আছে যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী এবং আমি প্রায়ই আলিমুদ্দিনে যেতাম তখন ওই সকালবেলায় উনি শাকসবজিগুলি সংগ্রহ করে একটা বড় ঝুড়িতে করে নিয়ে নীচে নেমে আসতেন।
সম্পাদক মণ্ডলীর বৈঠকে কোনোটা বুদ্ধবাবুকে, কোনোটা শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে দিতেন। নিরুপমবাবুর স্ত্রী অধ্যাপিকা এবং পার্টির খুব সক্রিয় কর্মী ছিলেন। নিরুপমবাবুর স্ত্রীকেও বিমানবাবু খুব স্নেহ করতেন। তার জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন একদম ফ্রেশ শাকসবজি। এইসব দৃশ্য তো নিজের চোখে দেখা। আর যে সময়টা আমি দেখিনি অর্থাৎ বিমানদার ছোটবেলা। সেই সব কথা আমি বিমানদার মুখে অনেক শুনেছি। একবার বিমানদা আমাকে বলেছিলেন যে, উনি কলেজ জীবনে সন্ন্যাসী হয়ে যেতে চেয়েছিলেন এবং স্বামী লোকেশ্বরানন্দকে খুব ভালোবাসতেন এবং লোকেশ্বরানন্দর কাছে যেতে যেতে খুব ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠেছিল। কেননা স্বামী লোকেশ্বরানন্দজি খুব সেরিব্রাল সন্ন্যাসী ছিলেন। পড়াশোনা করতেন, উপনিষদের নানা রকম ব্যাখ্যা করতেন। বিমানদার সেখানে গিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হত। লোকেশ্বরানন্দজির অনুপ্রেরণায় উনি সন্ন্যাসী হবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন। বিমানদা আমাকে বলেন বাধ সারলেন বিনয় চৌধুরী। আর এক প্রয়াত ও প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা।
বিনয়দা বললেন যে, কী? সন্ন্যাসী হবে! এখন রাজনীতিতে আসতে হবে, কতো কাজ করতে হবে। বিনয় চৌধুরী কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীও ছিলেন।পশ্চিমবঙ্গের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে ভূমি সংস্কারের একটা বিরাট কৃতিত্ব কিন্তু বিনয়বাবুর নিশ্চয়ই বর্তায়। সে বিনয়বাবুর চাপে ওঁর আর সন্ন্যাসী হওয়া হল না, রাজনীতিতে চলে এলেন। রাজনীতির গল্পও কিন্তু কম নয়। বিমানদা আর শ্যামল চক্রবর্তী খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শ্যামল চক্রবর্তী তাঁর আত্মজীবনীতে একটা দারুণ গল্প লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন যে, আমারা যখনই খিদে পেত আর যখনই পৌষ সংক্রান্তি এইসব হত, বিমানদা দক্ষিণ কলকাতায় থাকতো বালিগঞ্জের কাছে একটা বাড়িতে সেখানে যেত আর বিমানদার মা ওঁদেরকে নানা রকমের নারকেল নাড়ু,পিঠেপুলি খাওয়াতন। আর কখনো কখনো গেলে নানা রকম ভাবে সব লুচি-টুচি তো হতই। সেই সব গল্প শুনেছি। বিমানদার দাদা উচ্চ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। সেখানে ভাল জীবনযাত্রাতেই বিমানদার কাটছিল। কিন্তু রাজনীতিতে অংশ নিয়ে এমন হল যে অনেক রাত হত বাড়ি ফিরতে, আর মা জেগে বসে থাকত। খুব কষ্ট হত বিমানদার। মাকে খুব ভালোবাসতো, সেই কারণে মায়ের যাতে কষ্ট না হয় তাই দিনের বেলা দেখা করে রাতের বেলা বেশি রাত হয়ে গেলে ওই সম্ভবত মৌলালির কাছে কৃষকসভার একটা পার্টি অফিস ছিল সেই পার্টি অফিসেই রাত্রিবেলা শ্যামলদা, বিমানদা সবাই একসঙ্গে শুয়ে পরত।
তাতে মায়ের হয়তো আরো কষ্ট হতো। সেটা হয়তো বিমানদা তখন বোঝেনি।
যাই হোক, তারপরে তো ঘর ছেড়ে বেরিয়েই চলে এল। পার্টির হোলটাইমার হয়ে গেল বিমানদা। জেলায় জেলায় ঘুরছে। বিমানদার কাছে বসলে বিমানদা ভীষণভাবে এখন মায়ের কথা বলে, মাকে স্মরণ করে বিমানদা। সারাক্ষণ মায়ের গল্প করে। সেটা নিয়ে পার্টিতে বেশ আলোচনাও আছে যে, এরকম মাতৃভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খুব কমই দেখা যায় যে মায়ের গল্প অনর্গল বলে চলে। বিমানদার অনেক অবদান এর মধ্যে একটা মস্ত বড় অবদান হচ্ছে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তুলে ধরা। বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বিদ্যাসাগর মেলাটা কিন্তু বিমানদা চালু করেছিলেন। আমরা অনেক মনীষীদের চর্চা করি, যথেষ্ট করি না বিদ্যাসাগরের। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেদিনীপুরে গিয়ে বিদ্যাসাগরের মেলা করা, তারপর কলকাতায় মেলা হওয়া এবং এই বিদ্যাসাগরকে নিয়ে চর্চা, আলোচনা, সেমিনার, ডিবেট এই সবে কিন্তু বিমান দার একটা বিশেষ উৎসাহ এবং উদ্যোগ ছিল।
এহেন বিমানদা অবসর নিলেন। অবসর জীবনটা তিনি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেই কাটাবেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বিমানদা অবসর নিলেও আলিমুদ্দিনের দোতলায় এসে বিমানদাকে দেখা যাবে এ ঘর-ওঘর ঘুরছেন এবং মুখে একটা বিড়ি। এই সেদিনও বিমানদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জিগ্গেস করেছিলাম, বিমানদা বিড়ি খাচ্ছেন কেন? উনি বললেন, লোকে অনেকে বলছে বিড়িতে ক্ষতিটা কম,একেবারে ছাড়তেও পারছি না,আর একটা কথা হচ্ছে বিড়িটা একটু সস্তাও তো হয় বলো। তো যাই হোক এই হলেন বিমান বসু।
বিমান বসুর শুধু রাজনীতি নয় অন্যান্য অনেক ব্যাপারে সাহিত্য,শিল্প, সংস্কৃতিতেও যথেষ্ট আগ্রহ আছে। সেকথাও খুব কম লোকই জানে। বিমানদা, বুদ্ধবাবু আর অনিল বিশ্বাস এই তিনজনকে প্রয়াত সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত নাম দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির 'ত্রয়ী'। প্রমোদ দাশগুপ্তের হাতে করে তৈরি করা যারা কয়েকজন তাদের মধ্যে এই তিনজন। প্রমোদ দাশগুপ্ত নাকি ঠিক করে গেছিলেন বিমান কি কাজ করবে,অনিল বিশ্বাস পার্টির গণশক্তি এবং পাবলিকেশন এবং প্রচার দেখবে এবং বিমান সংগঠন দেখবে আর বুদ্ধ প্রশাসন দেখবে। এই ভাবেই তৈরি হয়েছিল প্রমোদ বাবুর এই টিম। সেই প্রবীণ এবং নবীন প্রজন্মের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে বরুণ সেনগুপ্ত অনেক লিখেছেন। প্রমোদ দাশগুপ্ত তো অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন বরুণ সেনগুপ্তর। সেই কারণে আমি নিজের চোখে দেখেছি বিমান দাও বরুণ বাবু কে খুব শ্রদ্ধা করতেন।এখনো বরুনবাবুর কথা কিন্তু উনি সব সময় বলেন। বরুণ বাবু জ্যোতিবাবুর সমালোচনা করতেন। আদর্শগতভাবে অনেক ব্যাপারে হয়তো বিমান বসুর রাজনীতির সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিমান বসুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনো কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি কিন্তু খেতে ভালোবাসেন,আর রান্নাও করতে পারেন। বিমান দা চাইনিজ খেতে খুব ভালোবাসতেন।
চাইনিজ দোকানে গিয়ে চিনে খাওয়াটা এটা একটা বিমান দার আল্টিমেট বিলাসিতা ছিল। আর দিল্লিতে যখন যেতেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে থাকতেন। অশোকা রোডের বাংলোতে ওখানে রাত্রিবেলা থাকতেন। পার্টি মিটিংয়ে আর সকাল বেলার ব্রেকফাস্টটা নিজে বানাতেন। আর ধোসা বানাতে খুব ভালোবাসতেন। দক্ষিণ ভারতীয় খাবার সবই প্রায় তিনি বানাতে পারতেন। সেই ব্রেকফাস্ট খেতে হতো। সোমনাথ চ্যাটার্জি ও খুব আনন্দ করে বিমান দার সেই তৈরি করা খাবার খেতেন। বিমান দা খুব রান্না পটু ছিলেন এবং এখনো কিন্তু নিজে রান্না করতে ভালোবাসেন। এরকম একটা চিত্তাকর্ষক চরিত্র বিমান বসু। আশা করা যায় তিনি দল থেকে অবসর নিলেও দলের একটা অন্যতম অভিভাবক হিসেবে এখনো থাকবেন।