Teachers Day Exclusive, Rastar Master: যাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হয়, তাদের কাছে রোজ স্কুলে যাওয়া বা স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাও যেন ‘বিলাসিতা’! এই পরিস্থিতে যদি পরিবারের পাঁচ জনের মধ্যে মাত্র একজনের স্কুলে যাওয়ার উপায় থাকে, তাহলে কার আগে শিক্ষিত হওয়া জরুরি? মায়ের, যিনি ওই পরিবারের কর্তৃ। একটুও না ভেবে উত্তর দিলেন পশ্চিম বর্ধমানের জামুরিয়ার তিলকা মাঝি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বীপনারায়ণ নায়েক। এলাকায় অবশ্য তিনি ‘রাস্তার মাস্টার’ নামেই বেশি পরিচিত। তিনি বলেন, “মা শিক্ষিত হলেই শিক্ষার আলো পৌঁছাবে গোটা পরিবারে, শিক্ষিত হবে গোটা পরিবার। তাই কোনও পরিবারের সার্বিক শিক্ষার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেয়ে ও মায়েদের শিক্ষার্জন।”
নিজে আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় আদিবাসী এলাকার পড়ুয়াদের স্কুল-ছুটের নানা কারণই জানা দ্বীপনারায়ণ নায়েকের। তাই নুন আনতে পান্তা ফুরানো, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলে মেয়েদের স্কুলে ফেরানোর জন্য আগে তাদের মায়েদের স্বাক্ষরতার আলোয় নিয়ে আসতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে স্কুল-ছুট ছেলে মেয়েদের মায়েদের স্বাক্ষর করার উদ্যোগে ক্যাম্প চালু করেন দ্বীপনারায়ণবাবু। পরে সেখানে ল্যাপটপ, অনুবিক্ষণযন্ত্রের মাধ্যমে খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার মুক্তাঙ্গন ‘রাস্তার স্কুল’ গড়ে তোলেন তিনি। ক্রমশ সেখানে বাড়তে থাকে পড়ুয়ার সংখ্যা। আর সপ্তাহান্তে নিয়মিত এখানে পড়াতে পড়াতেই দ্বীপনারায়ণবাবু এলাকার মানুষজনের কাছে হয়ে উঠলেন 'রাস্তার মাস্টার'।
জামুড়িয়ার জামডোবা আর নীলপুর আদিবাসী গ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকার আদিবাসী পরিবারগুলিতে শিক্ষা বিস্তার একেবারে ‘শূন্য’ থেকে শুরু হয়েছিল এই রাস্তার মাস্টারের হাত ধরেই। অর্থাৎ, তাঁর অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ বা পরিবারের মধ্যে প্রথম স্কুল পড়ুয়া। ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা সামাজিক ও স্বাস্থ্য সচেতনতার পাঠও পড়ান তিনি। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় একটা গোটা আদিবাসী গ্রামকে আধুনিক করে তোলাই স্বপ্ন ‘রাস্তার মাস্টার’-এর।
আদিবাসী মানুষগুলোর মনে যুগ যুগ ধরে বাসা বেঁধে থাকা নানা কুসংস্কারের সঙ্গেও লড়াই করতে হয় দ্বীপনারায়ণবাবুকে। জ্বর এলে ওঝার কাছে নয়, প্রয়োজন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে— আদিবাসী এলাকার মানুষগুলোকে এটা বিশ্বাস করাতে পেরেছেন তিনি। করোনার টিকা না নিতে চাওয়া মানুষগুলোকে টিকার লাইনেও পাঠিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য, এ সব কাজেই নিজের পরিবারের সদস্য আর স্কুলের সহকর্মীদের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। কারণ, একার হাতে এই ধরনের কোনও বড় কাজ কখনওই সম্ভব নয়, জানালেন দ্বীপনারায়ণবাবু।
দীর্ঘ লকডাউনকালে যখন দেশজুড়ে স্কুল-কলেজ সব বন্ধ, তখনও নিজের ‘রাস্তার স্কুল’-এ করোনাবিধি মেনে গরীব আদিবাসী মানুষগুলোকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘রাস্তার স্কুল’-এ পড়া ছাত্রীরা কেউ এখন দিল্লিতে পড়তে যাচ্ছে, কেউ এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরে কোথাও নার্সিং পড়তে চলেছে। ‘আর এই মেয়েগুলোই এলাকার বাকি দশটা মেয়েকে লেখাপড়া করতে উৎসাহিত করছে। এদের পরিবারগুলোও শিক্ষার আলোয় এসে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে’, বলার সময় আবেগে গলা ভারী হয়ে যায় দ্বীপনারায়ণবাবুর।
দারিদ্র, নানা কুসংস্কারের শিকলে বাঁধা গরীব আদিবাসী মানুষগুলোকে শিক্ষার আলোয় এনে মুক্তির স্বাদ দিতে, বাঁচার নতুন স্বপ্ন দেখাতে চান দ্বীপনারায়ণবাবু। জামুড়িয়ার আদিবাসী গ্রামগুলিতে যখন ইলেক্ট্রিকের আলো পৌঁছায়নি, তখন থেকেই সেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে চেয়েছেন রাস্তার মাস্টার। গত বছর আর এই নজিরবিহীন কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মানও পেয়েছেন তিনি। বিশ্বের ১২-১৫টি দেশের মনোনিত শিক্ষকদের লম্বা তালিকা পেরিয়ে ‘গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড ২০২২’ (Global Teacher Award 2022) পেয়েছেন তিলকা মাঝি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বীপনারায়ণ নায়েক। তবে ‘এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি’ নিজেই বললেন জবা গ্রামের রাস্তার মাস্টার।