বাংলা, হিন্দি, মালায়ালম-সহ অনেক ভাষায় অভিনয় করেছেন লিলি চক্রবর্তী। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray), তপন সিংহ (Tapan Sinha), তরুণ মজুমদার (Tarun Majumdar), গুলজার (Gulzar), হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় (Hrishikesh Mukherjee) থেকে বর্তমান সময়ের সেরা পরিচালকদের সঙ্গে সাবলীল ভাবে কাজ করছেন। উত্তম কুমার (Uttam Kumar), সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) থেকে বিনোদ খান্না (Vinod Khanna), অমিতাভ বচ্চন (Amitabh Bachchan), ধর্মেন্দ্র (Dharmendra) সকলের সঙ্গে দাপটের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন।
১৯৫৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য ছবিতে দারুণ চরিত্র দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। অনেক কিছু পেয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে না পাওয়ার তলিকাও বেশ দীর্ঘ অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী-র (Lily Chakravarty). আজ তাঁর ৮০তম জন্মদিন। এখনও সমান ভাবে অ্যাক্টিভ রয়েছেন। করোনাকে হারিয়েছেন। সম্প্রতি শেষ করেছেন কয়েকটি ছবির শুটিংও। জন্মদিনে আজতক বাংলার বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এই অসাধারণ সুন্দরী অভিনেত্রীকে।
লিলির জন্ম ওপার বাংলার বিক্রমপুরে। সম্পন্ন পরিবারেরই সন্তান ছিলেন। বাবা বড় ব্যবসাদার। দেশভাগের যন্ত্রণায় এপারে চলে আসতে হয়। শুরু হয় কষ্টের জীবন। মানিকতলার ভাড়াবাড়ির চাল বেয়ে বর্ষায় অনবরত জল পড়ত। বাবা ব্যবসায় এদেশে সুবিধা করতে পারেন না। এই সময় মা দীপালি চক্রবর্তী সংসারের সুরাহার জন্য হয়ে ওঠেন মঞ্চের অভিনেত্রী। পরে তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নান্দীকার’–এরও নিয়মিত অভিনেত্রী হয়েছিলেন। তখনকার প্রায় সব ক’টা প্রধান প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন।
লিলির অবশ্য গ্রুপ থিয়েটারে আসা হয়নি। কারণ, অভিনয় ছিল তাঁর কাছে অর্থোপার্জনের মাধ্যম। তাঁর মেজদিও তখন অফিস ক্লাবে বা নানা শৌখিন ক্লাবে পেশাদার অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করছেন। লিলি এই সময়টা ছিলেন মধ্যপ্রদেশে বড় মামার কাছে। কলকাতায় ফিরে দিদির পিছু নিয়ে চলে এলেন ক্লাবের থিয়েটারে। আর সেটাই হল তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
১৯৫৮ সাল। পরিচালক কণক মুখোপাধ্যায় তখন ‘ভানু পেল লটারি’ ছবিটি তৈরি করছেন। সেই ছবিতে ছোট্ট এক রোলে কাজ পেলেন লিলি। অল্প কাজ। কিন্তু কঠিন কাজ। কারণ একই দৃশ্যে স্ক্রিন শেয়ার করছেন কমল মিত্র আর জহর রায়। শুটিংয়ের পরের দিন রিহার্সাল রুমে এলেন কিশোরী লিলি। তখনও বুঝতে পারছেন না তিনি কেমন কাজ করছেন। তার আগে ক্যামেরা ফেস করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু অত্যন্ত সাবলীল অভিনয়ে তিনি তৎকালীন সময়ের দাপুটের অভিনেতাদের মাঝে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর ক্যামেরা-সফর শুরু।
তাঁর আত্মজীবনী 'আমি লিলি'তে নিজের কেরিয়ার, না পাওয়া, দাম্পত্য-সংসার সব নিয়েই খোলামেলা আলোচনা করেছেন প্রবীণ অভিনেত্রী। কত বার শুধুমাত্র রাজনীতি এবং ব্যাকস্ট্যাব করার কারণে বহু ভালো সিনেমা হারাতে হয়েছে তাঁকে। কখনও ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি। যেমন ধরা যাক অপুর সংসার। লিলি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের দ্বিতীয় পছন্দ। লুক টেস্টও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শর্মিলা ঠাকুরের একটা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ডেট পাকা করতে পারছিলেন না সত্যজিৎ। জানিয়েও রেখেছিলেন, যদি শর্মিলা না করতে পারেন, তবে লিলি অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় করবেন। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তা সিনেমাপ্রেমী মাত্রেই জানবেন।
শুধুমাত্র উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করবেন বলে পরিচালক শক্তি সামন্ত-র ছবি ছেড়ে বম্বে থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। সেই উত্তম কুমার স্বয়ং তৎকালীন এক দাপুটে অভিনেত্রীর কথায় তাঁর ছবি থেকে লিলিকে বাদ দিয়েছিলেন। এক পরিচালকও পছন্দের নায়িকাকে নিতে লিলিকে বাদ দিয়েছিলেন সিনেমা থেকে। এক নায়িকাকে পুরস্কারের হ্যাটট্রিক করানো হবে বলে তাঁকে পুরস্কার দেওযা হয়নি, এ সবই আত্মজীবনীতে রয়েছে। না পাওয়ার আক্ষেপ বইয়ের বহু ছত্রে ব্যক্ত করেছেন লিলি। তবে তিনি অভিনয় জীবনে যা পেয়েছেন, তা সকলের ভাগ্যে জোটে না।
৬৩ বছর পর আজও তিনি দর্শকদের আনন্দ দিয়ে চলেছেন তাঁর সাবলীন অভিনয়ের মাধ্যমে। বেশ কয়েকটি প্রজন্মের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা সকলের হয় না। অনেকে মানিয়ে নিতেও পারন না। লিলি সে দিক থেকে ব্যতিক্রম। শেষ দিকে সম্মান এবং পুরস্কারও ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। তবে সেরা কাজের জন্য যদি কেউ পুরস্কার না পান, সেই আক্ষেপ সহজে যাওয়ার নয়। কিন্তু লিলি সে সমস্ত আঁকড়ে ধরে রাখতে চান না। তাঁর জীবনের মন্ত্র, 'যাক যা গেছে তা যাক...'
কৃতজ্ঞতা: আমি লিলি (লিলি চক্রবর্তীর আত্মজীবনী)