একটা সময় ছিল যখন তাঁর খেলায় মুগ্ধ ছিল গোটা দেশ। বলা হত, স্বয়ং ঈশ্বর নাকি ভারতীয় ফুটবলকে উপহার হিসেবে বাইচুং ভুটিয়াকে পাঠিয়েছেন। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি ম্যাচে বাইচুং যে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করতেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে সকল ফুটবলাররা ভারতকে তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাইচুং ভুটিয়া। দেশের এই কিংবদন্তি ফুটবলার আজ ৪৪ বছর বয়সে পা রাখলেন। ইতিমধ্যে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে চারবার আইলিগ খেলেছেন বাইচুং। এই লাল-হলুদ শিবিরেই তিনি নিজের ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ইংলিশ ক্লাব বেরি'তে যোগ দেন। বাইচুংই প্রথম ভারতীয় ফুটবলার যিনি ইউরোপীয় কোনও ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। পাশাপাশি মহম্মদ সেলিমের পরা বাইচুং দ্বিতীয় ফুটবলার যিনি ইউরোপের কোনও ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেন।
(ছবি -পিটিআই)
এরপর তিনি লোনে চলে আসেন মালয়েশিয়ার ফুটবল ক্লাব পেরাক এফএ-তে। তবে ভারতীয় ক্লাবগুলোর মধ্যে জেসিটি মিলস এবং মোহনবাগানের হয়ে খেলেন বাইচুং। জেসিটি'র হয়ে একবার আইলিগ জয় করতে পারলেও মোহনবাগানের হয় দু'বার খেলেও তিনি লিগ জয় করতে পারেননি। ইতিমধ্যে মধ্যে বাইচুং নেহরু কাপ, এলজি কাপ, তিনবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ জয় করেছেন। দেশের হয়ে তিনি ৮২টি ম্যাচ খেলেছেন। জেরি জ়িরসাঙ্গার পর ভারতের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেন বাইচুং। এই প্রসঙ্গে আপনাদের জানিয়ে রাখি, ১৯৯৫ সালে নেহরু কাপে উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করেছিলেন বাইচুং। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর, ৯০ দিন।
(ছবি -পিটিআই)
১৯৯৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাইচুং কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন। এর বছর দুয়েক পর তিনি ফাগওয়াড়ার জেসিটি মিলস দলে যোগ দেন। সেখানেই ১৯৯৬-৯৭ মরশুমে তিনি জাতীয় ফুটবল লিগ জয় করেন। এই লিগে সবথেকে বেশি গোল করেছিলেন বাইচুং। ১৯৯৬ সালে তাঁকে বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে তিনি আবারও ইস্টবেঙ্গলে ফিরে আসেন। ১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে কলকাতা ডার্বিতে তিনি হ্যাটট্রিক করেছিলেন। সেই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল ৪-১ গোলে জয়লাভ করেছি। প্রায় দেড়লাখ দর্শকের সামনে অমন ফুটবল উপহার দেওয়ার পর বাইচুংকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৮-৯৯ মরশুমে তাঁকে ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেবছর ইস্টবেঙ্গল রানার্স আপ হয়েই লিগ শেষ করেছিল। ১৯৯৯ সালে তাঁকে অর্জুন পুরস্কারে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সম্মান জানানো হয়।
(ছবি -পিটিআই)
২০০২ সালে ভারতে ফিরে এসেছিলে বাইচুং। তারপর একবছর তিনি মোহনবাগানের হয়ে খেলেন। কিন্তু, মরশুমের শুরুতেই চোট পাওয়ার কারণে, তাঁকে সেভাবে মাঠে দেখতে পাওয়া যায়নি। সেবছর মোহনবাগান একটি মাত্র ট্রফি জয় করেছিল। অল এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপ। কিন্তু, সেই টুর্নামেন্টে বাইচুং খেলতে পারেননি। তবে এরপর তিনি আবারও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ফিরে আসেন। সেইসঙ্গে এই ক্লাবের হয়ে আসিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেন। ফাইনাল ম্যাচ বাইচুং একটি গোল করেছিলেন। এই ম্যাচে টেরো সাসানার বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল ৩-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। বাইচুংকেই ম্যাচের সেরা নির্বাচন করা হয়। গোটা চ্যাম্পিয়নশিপে ৯ গোল করে তিনিই সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।
(ছবি -পিটিআই)
১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি গ্রেটার ম্যানচেস্টারের বেরি ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। পাশাপাশি মহম্মদ সেলিমের পরা বাইচুং দ্বিতীয় ফুটবলার যিনি ইউরোপের কোনও ক্লাবের হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলেন। এই ক্লাবের সঙ্গে তাঁর তিন বছরের চুক্তি ছিল। পাশাপাশি তিনিই প্রথম ফুটবলার যাঁকে ইউরোপের কোনও ফুটবল ক্লাব সই করিয়েছিল। ফুলহ্যাম, ওয়েস্ট ব্রোমউইচ অ্যালবিয়ন এবং অ্যাস্টন ভিলায় ট্রায়ালে ব্যর্থ হওয়ার পর বাইচুংয়ের কাছে এই সুযোগ আসে। ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর কার্ডিফ সিটির বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। এই ম্যাচে তিনি ইয়ান লসনের পরিবর্তে মাঠে নেমেছিলেন। এবং দলের দ্বিতীয় গোলে তাঁর ভূমিকা অসাধারণ ছিল। বাইচুংয়ের ভলিকে কাজে লাগিয়ে গোল করেছিলেন ডারেন বুলক। ২০০০ সালের ১৫ এপ্রিল চেস্টারফিল্ডের বিরুদ্ধে ইংলিশ লিগের প্রথম গোলটি করেছিলেন বাইচুং ভুটিয়া।
(ছবি -টুইটার)
২০০৯ সালের ২২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে একবছরের চুক্তি করেন বাইচুং ভুটিয়া। জানিয়ে দেন, কেরিয়ারের শেষ ম্যাচটি তিনি এই ক্লাবের হয়েই খেলতে চান। সেইসঙ্গে তিনি এও ঘোষণা করেছিলেন যে এতদিন পর আবারও নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন। বাইচুং বলেছিলেন, "মনে হচ্ছে, আবারও যেন নিজের ঘরেই ফিরে এসেছি। যে ক্লাব থেকে আমি নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলাম, সেখানেই আবার শেষ করতে চলেছি।" যদিও মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে সেইসময় তাঁর কিছু আইনি জটিলতা তৈরি হয়। আর সেকারণেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে তিনি অর্ধেকটা মরশুমের জন্যই চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। এরপর তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন। জাতীয় ফুটবল দল থেকে তিনি ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। শেষ ম্যাচটি এএফসি কাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে তিনি খেলেছিলেন। বাইচুংয়ের ইচ্ছে ছিল আরও একবার লাল-হলুদের জার্সি গায়ে ম্যাচ খেলে অবসর গ্রহণ করা।
(ছবি -টুইটার)
ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করার পর বাইচুং 'ঝলক দিখলা যা' অনুষ্ঠানের তৃতীয় মরশুমের বিজয়ী হন। এই প্রতিযোগিতা জিতে পুরস্কার বাবদ বাইচুং ৪০ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। ফাইনালে তিনি করণ সিং গ্রোভার এবং গওহর খানকে পরাস্ত করেন। এই পুরস্কার অর্থের অর্ধেকটা বাইচুং একটি চ্যারিটিতে দান করেন। বাকিটা তিনি দিয়ে দেন নিজের কোরিওগ্রাফারকে। তিনি এও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আয়লা বিধ্বস্ত জায়গাগুলোর উন্নয়নে তিনি আর্থিক সাহায্য করবেন। এরপর তৃণমূল কংগ্রেসে বাইচুং যোগ দিলেও সেভাবে কিছু করে উঠতে পারেননি। ২০১০ সালে কার্লোস কুইরেজ় এবং নাইকের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাইচুং দিল্লিতে এক ফুটবল স্কুল গড়ে তোলেন। এরপর সিকিম ভূমিকম্পের কবলে পড়েন তিনি। যদিও তিনি নিজে কোনও চোট পাননি, তবে তাঁর ইউনাইটেড সিকিমের অফিস একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। অবশেষে তিনি নেহা ধুপিয়া এবং রাহুল বোসকে সঙ্গী করে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মানুষজনকে আর্থিকভাবে সাহায্য় করেছিলেন।
(ছবি -টুইটার)