
মহিলাদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়। হরমনপ্রীত কউর, স্মৃতি মন্ধানা, জেমাইমা রড্রিগেজ, শেফালি বর্মা, দীপ্তি শর্মা, রিচা ঘোষরা কেবল এই খেতাব জেতেননি, অজস্র-অসংখ্য মেয়ের স্বপ্নপূরণ করেছেন। ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে রবিবারের এই রাত ঐতিহাসিক করে তোলেন তাঁরা। জানেন তাঁদের এই বিশ্বকাপের জার্নিটা কেমন ছিল?

বাঁধনছাড়া উচ্ছ্বাস শুরু হয় ৪৬ ওভারের শেষ বলে হরমনপ্রীত কউরের লোপা ক্যাচ থেকেই। ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ফেলেন উইমেন ইন ব্লু। প্রতিটি খেলোয়াড়ের চোখে-মুখে সেই আবেগ ছির স্পষ্ট। গর্বের মুহূর্ত হয়েছে ক্যামেরাবন্দি। নিজস্ব নিজস্ব স্ট্রাগল পেরিয়ে বিশ্বকাপ হাতে তুলেছেন হরমনপ্রীত, জেমাইমা, রিচারা। শেফালির উদ্দীপনা, শান্তশিষ্ট স্মৃতি, আগ্রাসী হরমনপ্রীত এবং দীপ্তির পরিশ্রমের ফসল এই কাপ। রোহিত শর্মার ছেলের দল যা পারল না তা হরমনপ্রীত অ্যান্ড কোং করে দেখাল।

বরাবরই সাহসী হরমনপ্রীত কউর। তবে সাহসের পিছনে রয়েছে দৃঢ়তা এবং অধ্যাবসায়। পঞ্জাবের মোগা জেলার বাসিন্দা ৩৬ বছরের এই মেয়ে স্টিরিওটাইপের সঙ্গে বরাবরই লড়াই করেছেন। পুরুষশাসিত সমাজে কীভাবে দাপটের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে তা শিখিয়েছেন হরমনপ্রীতের বাবা, হরমন্দর সিং মৃভুল্লার। তিনি নিজেও বাস্কেটবল এবং ভলিবল খেলতেন। মা অবশ্য বলেছিলেন ছেলেদের মতো খেলাধুলো না করে রান্না শিখতে। বলেছিলেন সালওয়ার কামিজ পরতে। ২০০৯ সালে ডেবিউয়ের পর থেকে ক্রিকেট কেরিয়ারে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়েছেন হরমনপ্রীত। ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড কাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াকু ১৭১ রানের ইনিংস সকলের মনে থাকবে।

ব্যাটলগ্রাউন্ড ইন্ডিয়া নিয়ে মোবাইলে ডুবে থাকতেন সর্বক্ষণ। এটাই নাকি সবচেয়ে প্রিয় স্ট্রেস বাস্টার স্মৃতি মান্ধানার কাছে। তবে ক্রিকেট খেললেও স্মৃতি রান্না করতে ভালোবাসেন। পঞ্জাবি রান্না শেখার ক্লাসেও যান তিনি। স্পাইসি পনির টিক্কা মাসালা রাঁধের দুর্দান্ত। বলিউড এবং হলিউড সিনেমা দেখতেও পছন্দ করেন স্মৃতি।

ড্রেসিং রুমে গান গেয়ে, রিল বানিয়ে মাতিয়ে রাখেন ২৫ বছরের জেমাইমা রড্রিগেজ। ৭ বছর বয়সে ক্রিকেট খেলা শুরু। বাবাই তাঁর প্রথম কোচ। তবে বাবার বিরুদ্ধে ওঠা ধর্মান্তকরণের অভিযোগের কারণেই জিমখানা ক্লাব থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। মানসিক অবসাদেও ভুগছিলেন তিনি। তবে লড়াই ছাড়েননি। টিম থেকে ড্রপ হয়েও বিশ্বকাপে ফিরে আসেন ফিনিক্স পাখি হয়ে।

প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট দীপ্তি শর্মা কেবলমাত্র একজন অলরাউন্ডারই নন, পুলিশের ডেপুটি সুপারও। ভাইকে দেখে ক্রিকেট খেলার নেশা শুরু হয়েছিল দীপ্তির। চলতি বিশ্বকাপে তিনিই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ রান সম্পন্ন করেন। নিয়েছেন ১৫টি উইকেট।

শিলিগুড়ির মেয়ে রিচা এখন প্রথম বিশ্বকাপজয়ী বাঙালি। ১৪ বছর বয়সে বাংলার সিনিয়র টিমে অভিষেক হয় রিচার। ২০২০ সালের টি২০ ওয়ার্ল্ড কাপে ১৬ বছরের রিচাই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ছোটবেলা থেকে ছেলেদের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন রিচা। তাই কোচেরা বলেন, চাপের মুখে নির্ভয়ে খেলতে অভ্যস্ত তিনি। ২০২৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৮ নম্বরে নেমে ৯৪ রান করে রেকর্ড গড়েছিলেন বঙ্গকন্যা। ভাল খেললেই মায়ের হাতের ফ্রায়েড রাইস খেতে শিলিগুড়ি ছোটেন রিচা।

মোহালির গলি থেকে ভারতের ড্রেসিং রুম পর্যন্ত পৌঁছনোর জার্নিটা সহজ ছিল না আমনজোৎ কউরের কাছে। ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট অনুশীল করার জন্য কটাক্ষের শিকার হয়েছেন তিনি। ঠাকুরমাই ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। ব্যাট ছিল না বলে খেলতে দেওয়া হয়নি আমনজোৎকে। পেশায় কাঠমিস্ত্রি বাবা নিজে হাতে গড়ে দিয়েছিলেন ব্যাট। কুকুরপ্রেমী আমনজোৎ মাঝে মধ্যেই ইনস্টায় নিজের পোষ্যের সঙ্গে রিল পোস্ট করেন।

হিমাচলপ্রদেশের সিমলায় পরসা নামে এক ছোট গ্রামে ১৯৯৬ সালে জন্ম রেনুকা সিং ঠাকুরের। ৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। ক্রিকেটার বিনোদ কাম্বলির নামে নিজের ছেলের নাম রেখেছেন রেনুকা। আর্থিক কষ্ট উপেক্ষা করে জাতীয় স্তরের স্টার ক্রিকেটার হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর মায়ের স্ট্রাগল।

বরাবরই বাড়ি থেকে ক্রিকেট খেলার জন্য উৎসাহ পেয়েছেন প্রতীকা রাওয়াল। বাবা প্রবীন রাওয়াল ছিলেন BCCI-এর আম্পায়ার। জাতীয় স্তরের বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন প্রতীকা। জিতেজেন স্বর্ণপদকও। দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় দুর্দান্ত মার্কসও পেয়েছেন তিনি।

মুম্বইয়ে জন্ম রাধা যাদবের। বাবা ওমপ্রকাশ যাদব সবজি এবং দুধের দোকান চালান। ধার করে প্যাড, গিয়ার নিয়ে অনুশীল করতেন ছোটবেলায়। সবজি বিক্রেতার মেয়ে থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রিকেটার হওয়ার নেপথ্যে ছিল বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা।

চণ্ডিগড় থেকে দ্বিতীয় মহিলা ক্রিকেটার হরলীন কউর দেওল। ছোটবেলায় দুষ্টু ছিলেন খুব। ব্যাডমিন্টন, হকি, ফুটবলও খেলতেন হরলীন। ৮ বছরেই অনুর্ধ্ব ১৯ দলের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। মেয়েদের সর্বদা ছাড় দেওয়া উচিত যাতে তারা নিজেদের কেরিয়ারে নিজেরা বেছে নিতে পারে, মনে করছেন হরলীনের বাবা।

অসম থেকে উঠে আসা উইকেটকিপার উমা ছেত্রী গানের ভক্ত। বরাবরই আধ্যাত্মিক উমা। নিজে ভজনও গাইতে পারেন। ছোট ছোট জিনিসেই উৎফুল্ল হন উমা। আলুর চাটনি খেতে খুব ভালোবাসেন।

অলরাউন্ডার স্নেহ রানা দেরাদুনের মেয়ে। ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। নিজের স্কেচ শেয়ারও করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ম্যাচের সময়ে টেনশনে থাকলে ছবি আঁকেন তিনি।

শেফালি বর্মা যখন ক্রিকেট শেখা শুরু করেছিলেন, ব্যাটের সাইজ তাঁর চেয়েও বড় ছিল। স্যাঁকরার মেয়ে শেফালিকে খেলা শিখিয়েছেন বাবাই। ৯ বছর বয়সে ভাইয়ের ছদ্মবেশ নিয়ে অনুর্ধ্ব ১২ দলে খেলেছিলেন তিনি। চুল কেটেছিলেন ছেলেদের মতো করে। সচিন আর বিরাটের ভক্ত শেফালিই এবার প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্টের খেতাব জিতেছেন।

ক্রান্তি গৌড় এমন একটি পরিবারে বড় হয়েছেন, যেখানে দু'বেলা অন্ন সংস্থানের লড়াইটাই ছিল সবচেয়ে বড়। ২০১২ সালে পুলিশের চাকরি খুইয়েছিলেন তাঁর বাবা। সেই ক্রান্তিই আজ নিজের রোজগারের অর্ধেক পিছিয়ে পড়া শিশুকন্যাদের দেখভালের জন্য দান করেন। পরিবারকে একটি বাড়ি কিনে দিতে চান তিনি।

হায়দরাবাদের মেয়ে অরুন্ধতী রেড্ডির দুনিয়াটাই তাঁর মাকে নিয়ে। মা ভাগ্য রেড্ডি পেশায় ভলিব খেলোয়াড়। তিনিই খেলা শিখিয়েছেন অরুন্ধতীকে। ১৮ বছর বয়সে মায়ের থেকে উপহার পাওয়া স্কুটি নিয়েই অনুশীলনে যেতেন তিনি। নিজের আইডল ধোনির মতো উইকেটকিপিং করতে চেয়েছিলেন অরুন্ধতী। তবে কোচেরা বুঝে যান ফাস্ট বোলিংয়ে তাঁর দক্ষতা রয়েছে।

বাঁ হাতি স্লো স্পিনার শ্রী চরণি ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার অন্যতম বড় নেপথ্য কারিগর। চলতি টুর্নামেন্টে ১৪টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। বাবা, দাদা এবং কাকাদের সঙ্গে খেলতেন তিনি। পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না, ধ্যান জ্ঞান ছিল ক্রিকেট।