
বছর মাত্র ২৫। এই বয়সী আর ৫ জন যখন রিলসের দুনিয়ার বিভর, জেমাইমা রড্রিগেজ তখন টিম ইন্ডিয়াকে পৌঁছে দিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে। নবি মুম্বইয়ের স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর ঝোড়ো ইনিংস ইতিহাস সৃষ্টি করল ভারতীয় ক্রিকেটে। একটা সময়ে যাকে ওয়ার্ল্ড কাপের দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, সেই জেমাইমাই ভারতকে পৌঁছে দিল ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে। 
 

নিজের যোগ্যতা নিয়ে আর কাউকে কোনও দিন একটা প্রশ্ন তোলারও অবকাশ দিলেন না জেমাইমা রড্রিগেজ। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১২৭ রানের অপরাজিত ইনিংস তাঁকে সর্বকালের অন্যতম সেরা মহিলা ক্রিকেটারের তকমা জুটিয়ে দিল। 

হরমনপ্রীত কউরের সঙ্গে বিধ্বংসী ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৩৮ রানের টার্গেট পূরণ করে ৫ উইকেটে ভারতকে জেতালেন জেমাইমা রড্রিগেজ। যা মহিলা ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করার এক অনন্য রেকর্ড গড়ে দিল। আর ২০২৫ সালের এই মহিলা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিল ৭ বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া।

২০০০ সাল জন্ম জেমাইমার। বড় হয়েছেন মুম্বইতে। বা সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপর স্নাতক পাশ করেন বান্দ্রারই রিজভি কলেজ অফ আর্টস, সায়েন্স অ্যান্ড কমার্স থেকে। বান্দ্রার সেই ক্লাসরুম থেকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ময়দান, স্বপ্নপূরণের জার্নিটা মোটেও সহজ ছিল না জেমাইমার।

ক্রিকেট নয়, স্কুলজীবনে জেমাইমা খেলতেন ফুটবল এবং বাস্কেটবল। জাতীয় স্তরের হকি খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। অনুর্ধ্ব ১৭ এবং অনুর্ধ্ব ১৯ হকি টুর্নামেন্টে মুম্বইয়ের হয়ে খেলতেন। ২০১২-১৩ সালে এসে যায় এক সুবর্ণ সুযোগ। অনুর্ধ্ব ১৯ মুম্বই ক্রিকেট দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। সেই থেকে শুরু। ক্রিকেটই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।

২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৭ বছর বয়সী জেমাইমা প্রথম মহিলা টি-২০ দলে সুযোগ পান। ওয়ানডে-তে প্রথম জাতীয় দলের হয়ে খেলের ২০১৮ সালের ১২ মার্চ। শান্ত স্বভাবের জেমাইমা নিজের দক্ষতাতেই মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে ভরসার যোগ্য হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালে স্মৃতি মন্ধানা ছাড়া তিনিই একমাত্র ব্যাটার হিসেবে অনুর্ধ্ব ১৯ ঘরোয়া মহিলা ক্রিকেটে ডবল সেঞ্চুরি করেন। যা তাঁর মুকুটে নয়া পালক জুড়েছিল।

এখনও পর্যন্ত ভারতের হয়ে ৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন জেমাইমা। ৫ ইনিংসে তাঁর রান ২৩৫। সর্বাধিক ৭৩ রান করেছেন টেস্ট ইনিংসে। গড় ৫৮.৮। ৩টি অর্ধশতকও রয়েছে টেস্ট কেরিয়ারে। ওয়ানডে খেলেছেন ৫৮টি। রান ১ হাজার ৭২৫। সর্বোচ্চ অপরাজিত ১২৭ (অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৫ সেমিফাইনালে)। ৩টি সেঞ্চুরি এবং ৮টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে জেমাইমার ঝুলিতে। টি-২০ ক্রিকেটে ১১২টি ম্যাচ খেলেছেন। রান ২ হাজার ৩৭৫।
 

মুম্বইয়ের অন্যতম প্রাচীন ক্লাব খাড় জিমখানা তাঁর সদস্যপদ বাতিল করে দিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, ক্রিকেটারের বাবা ইভান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ক্লাবের মধ্যে, যা ছিল নিয়মবিরুদ্ধ। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন জেমাইমা। বাবা ইভান আর মা লবিতা জানিয়েছেন, দু’বছর বয়স থেকেই মেয়েটা পুতুলের বদলে প্লাস্টিকের বল নিয়ে খেলত। তিন বছরের জন্মদিনে ওর ঠাকুর্দা একটা ব্যাট কিনে দেয়। সেই থেকেই মেয়ের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার ইচ্ছা বেড়ে যায়।

ছাত্র পড়ানোর রোজগার থেকেই ঘরে বোলিং মেশিন কিনে মেয়েকে বাড়িতে অনুশীলন করান জেমাইমার বাবা।  কভার ড্রাইভ, ব্যাকফুট ড্রাইভ, হুক, পুল, স্কোয়ার কাট শিখেছেন ধীরে ধীরে। পাশের বাড়িতে থাকার সুবাদে সচিন তেন্ডুলকরের থেকে পরামর্শ পেয়েছেন। পছন্দের ক্রিকেটার অবশ্য ধোনি। 
 

ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখন বিস্ময় আর উত্তেজনা দর্শকদের চোখেমুখে। ভারতের ইনিংসের শেষ মুহূর্তে ক্রিজে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন জেমাইমা রড্রিগেজ। প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ ট্রফি হাতে তুলে নিয়ে তিনি বলেন, 'এই জয় আমার কোচ, বাবা-মা, সতীর্থ আর সেই ঈশ্বরের জন্য, যিনি আমাকে শক্তি দিয়েছেন।'

জেমাইমা আরও বলেন, ‘স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। স্বপ্নটা এখনও শেষ হয়নি। সত্যিই গত এক মাসের কাজটা কঠিন ছিল। একা এটা করতে পারিনি। মা, বাবা, কোচ এবং আমার উপর যাঁরা বিশ্বাস রেখেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

তাঁকে যে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামতে হবে, তা তিনি জানতেনই না ৷ জেমাইমা বলেন, ‘আমি জানতাম না যে, তিন নম্বরে আমাকে ব্যাট করতে হবে। আমি স্নান করছিলাম। শুধু বলেছিলাম আমাকে জানাতে। মাঠে নামার পাঁচ মিনিট আগে, আমাকে বলা হয়েছিল যে আমি তিন নম্বরে আজকে ব্যাট করতে নামব।’
 

ম্যাচে ব্যাট করার সময়ে বারবার ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, নিজেই বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলছেন জেমাইমা। কী বলছিলেন? উত্তরে বলছেন, ‘যত সময় শেষ হয়ে আসছিল, তখন বাইবেল থেকে একটা স্ক্রিপচার বারবার বলছিলাম। সেটা হলো, স্ট্যান্ড স্টিল, গড উইল ফাইট ফর ইউ। ঠিক তাই হয়েছে। ভগবান লড়লেন আমার জন্য। আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম শান্ত থাকতে।’

জেমাইমা সেঞ্চুরির পরেও সে ভাবে সেলিব্রেট করেননি। কেন? বলছেন, ‘আমার হাফ সেঞ্চুরি বা সেঞ্চুরি জরুরি ছিল না। বহুবার আমরা কাছ থেকে ফিরে গিয়েছি। আজ যে কারণে ভারতের জয়টা অনেক বড় কথা।’ এতেই শেষ নয়। বলছেন, ‘এই টুর্নামেন্টে বাদ পড়তে হয়েছে। আমি প্রায় রোজই কেঁদেছি। কারণ মেন্টালি ডিস্টার্বড থাকতাম। দুশ্চিন্তায় থাকতাম। অবশেষে পেরেছি।’