ভেজাল নলেন গুড়শীত মানেই খেজুরের গুড়। আর নদিয়া জেলার একাধিক জায়গায় খেজুরের গুড় তৈরি করেন শিউলিরা। কারণ, শীত পড়তেই চাহিদা বাড়ে খেজুরের নলেন গুড়ের। জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে এই গুড়।
নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের সর্বত্রই খেজুর গাছ কেটে শিউলিরা সুস্বাদু নলেন গুড় করতে ব্যস্ত থাকেন। যদিও আগে যেভাবে নলেন গুড়ের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেই ধারা এখন অনেকটাই ধাক্কা খাচ্ছে।
তবুও বর্ষা বিদায় নেবার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় শিউলিদের খেজুর গাছ ঝোড়ার কাজ। তারপর একটি গাছ থেকে সপ্তাহে দু'দিন খুব বেশি হলে তিন দিন শিউলিরা গাছ কেটে রস বের করে থাকেন।
আর এই রস তৈরি করতে যেমন পরিশ্রম প্রয়োজন, তেমনই দরকার জ্বালানির। অনেকে আবার জমির মালিকের কাছ থেকে ২০০ টাকা করে গাছ কিনে রস বের করার কাজে নিজেদের করেন। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন এই চার মাসের জন্য গাছ লিজ নেন শিউলিরা। গাছ থেকে রস বের করে জ্বালানি দিয়ে যা পরিশ্রম হয়, তাতে খুব একটা লাভের মুখ দেখতে পান না শিউলিরা। অনেক ক্ষেত্রে নলেন গুড়ের শিউলিরা বাজারে খেজুরের গুড় বিক্রি করে লোকসানের মুখ দেখছেন। সেই জন্য নতুন প্রজন্ম আর এই খেজুর গুড়ের কাজে এগিয়ে আসছে না।
তবে এই লোকসান হওয়ার পিছনে অন্য একটি কারণ রয়েছে। সেটি হচ্ছে ভেজাল গুড়। আর এই ভেজাল গুড়ের দাপটে নলেন গুড়ের শিউলিরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন সর্বত্রই। শিবনিবাসের খেজুর গুড়ের শিউলি বাসুদেব বিশ্বাস বলেন, ২০টি গাছ কেটে রস হয় দুই থেকে চার হাড়ি। সেই রস জাল দিয়ে গুড় তৈরি হয় দুই থেকে তিন কেজি। খাঁটি নলেন গুড় বাজারে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ যারা গুড়ে চিনি মিশাচ্ছে তারা অল্প জ্বালানির খরচে গুড় তৈরি করে বাজারে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি করছে । অল্প রসে চিনি মিশিয়ে বেশি গুর করে যে পরিমাণ খরচ হয় লাভের দিক থেকে তা অনেকটাই বেশি।
এক সময় মাজদিয়ার বাজারে নলেন গুড়ের নাম ছিল রাজ্য থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আজ ভেজাল গুড়ের দাপটে নোলেন গুড়ের স্বাদ উধাও। তাই যারা খাঁটি নলেন গুড়ের কারবার করছেন, তারাও কিন্তু আজ লোকসানের মুখে পড়ছে। মাজদিয়ার গুড়ের ব্যবসায়ী মাধব ঘোষ বলেন, 'বাজারে আশি থেকে নব্বই টাকা কেজি দরে তারা গুড় কিনছেন সেই গুড় তারা কলকাতার বাজারে বিক্রি করছেন ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।'
যদিও মাজদিয়ার পাইকারি এক ব্যবসায়ী অমিত ঘোষ ক্ষোভের সঙ্গে জানান, মাজদিয়া বাজারে এখন সমস্ত ভেজাল গুড়। এই ভেজাল গুড়ের জন্য খেজুর গুড়ের মান শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরাও বাধ্য হয়ে এই ভেজাল গুড় কিনেই কলকাতার বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছি। ভেজাল গুড় হওয়ায় দাম অনেকটাই সস্তা। ৮০- ৯০ টাকা দরে কিনে ১২০ টাকা ১৩০ টাকা দরে কলকাতায় বিক্রি হচ্ছে।
আগে মাজদিয়ার খেজুরের গুড়ের হাত দিলে বা কাছে গেলেই একটা সুগন্ধ নলেন গুড় পাওয়া যেত। এখন নাকের মধ্যে গুড় ভরে দিলেও তার কোন গন্ধ নেই। গুড়ে চিনি মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। ভেজালের দাপটে মাজদিয়া নোলেন গুড়ের নাম ডুবে গেছে। সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের সর্বত্র জায়গাতে ১০০ কেজি চিনিতে এক ভার খেজুরের রস দিলে সেটা খেজুর গুড়ে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে অল্প জ্বালানির খরচে খেজুরের গুড় তৈরি করা হচ্ছে।
চিনি মেশালে যেমন একদিকে জ্বালানির সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে অল্প সময়ের মধ্যে খেজুর গুড় তৈরি করা যাচ্ছে। যা বাজারে নিয়ে গেলে তারা হাজার টাকার চিনির গুড়ে ২০০০ টাকার বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। বলা যেতেই পারে ভেজাল গুড়ের ফলে লাভের মুখ দেখছেন শিউলিরা। এই জন্যই আসল গুড়ের অর্থাৎ খাঁটি নলেন গুড়ের কদর কমে গিয়েছে ভেজাল গুড়ের দাপটে স্বাদ হারাচ্ছে খেজুরের নলেন গুড়। (রিপোর্টার: সুরজিৎ দাস)