scorecardresearch
 

দেবী চৌধুরানী মন্দির : শতবর্ষ পার করেও একই রকম রহস্যময়

জলপাইগুড়ির শিকারপুর চা বাগান ঘেরা ছোট্ট গ্রামে এই মন্দিরকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা উপকথা। গেট দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে পাশাপাশি দু’টি মন্দির। তার মধ্যে একটি  মা কালীর। কালীমন্দিরের পাশের যে মন্দিরটি রয়েছে, তাতে একটি পুরুষ ও একটি নারী মুর্তি রয়েছে। পাশাপাশি বাঘ, শিয়াল ও আরও কিছু বিগ্রহ আছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এটি শিব-পার্বতীর মন্দির। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, বিগ্রহ দু’টি ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর।

Advertisement
দেবী চৌধুরানী মন্দির দেবী চৌধুরানী মন্দির
হাইলাইটস
  • ইতিহাস আর মিথ শতবর্ষ পরেও মূল আকর্ষণ
  • দেবী চৌধুরানীর আসল রহস্য কোনটা
  • বাইরের পর্যটকের ভিড় খানিকটা কম

দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক

ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী, এই নাম দুটো বাঙালির কাছে কী ! বাঙালি সংষ্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে না থাকলে বুঝতে পারা যাবে না। আনন্দমঠ উপন্যাসের মাধ্যমেই তাদের পরিচিতি। আনন্দমঠ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যার প্রভাব অনস্বীকার্য। একটা উপন্যাস যেভাবে একটা জাতি, একটা সমাজকে এভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তা সমসাময়িক ছাড়া বোধগম্য হওয়া একটু কঠিন বটে। এহেন আনন্দমঠে বর্ণিত প্রতিটি চরিত্রই যে জনমানসকে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন হবে, তাতে আশ্চর্য কী ! সেই উপন্যাসের দুটি মূল চরিত্র ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী।

সন্ন্যাসী ঠাকুরের মন্দির

বিখ্যাত উপন্যাস হলে যা হয় আর কী ! পড়তে পড়তে কখন সত্যি, মিথ্যা, কিংবদন্তী, আসল-নকল মিলে মিশে এক হয়ে কালোত্তীর্ণ হয়ে যায় তা সাধারণ বোধের বাইরে চলে যায়। তাদের নামে যখন মন্দির, তখন তার সঙ্গে যে কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা মিথ জড়িয়ে থাকবে তা আশ্চর্য কী!  উত্তরবঙ্গে, বিশেষত তিস্তা নদী ঘেরা জলপাইগুড়ির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা কালীমন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই দু’টি ঐতিহাসিক  নাম। এ রকমই এক ইতিহাসের সাক্ষী সন্ন্যাসী ঠাকুরের মন্দির। স্থানী মানুষ ভবানী পাঠককে এখনও এ নামেই ডাকেন।

অ্যাডভেঞ্চার আর ইতিহাসের টানে ছোটা

জলপাইগুড়ির শিকারপুর চা বাগান ঘেরা ছোট্ট গ্রামে এই মন্দিরকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা উপকথা। গেট দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে পাশাপাশি দু’টি মন্দির। তার মধ্যে একটি  মা কালীর। এখানে প্রতি বছর নিয়ম করে দু’বার কালীপুজো হয়। একবার আষাঢ় মাসে, আর একবার কার্তিক মাসে। খুব বড় না হলেও নিয়মনিষ্ঠায় ঘাটতি থাকে না। ইদানীং দু একজন অত্যুৎসাহী কালীপুজোয় রাতে গাড়ি নিয়ে খানিকটা ইতিহাস খানিকটা অ্যাডভেঞ্চারের টানে হাজির হন। 

Advertisement

পুজোতে কোনও ভক্তির অভাব নেই

সারা বছর পুজোর জন্য একজন পুরোহিত  থাকেন। তিনি স্থানীয় জনজাতির। তবে আষাঢ় ও কার্তিক মাসের পুজো করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী এখানে এখনও ছাগল ও পায়রা বলির প্রচলন আছে। চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেরাই চাঁদা তুলে পুজোর আয়োজন করেন। দীপাবলির রাতের পুজোয় শুধু গ্রামবাসী নয়, ভিড় জমান অনেক দূরের গ্রাম থেকে আসা মানুষও। রাতভর চলে পুজো। এলাকায় জমজমাট মেলা বসে।

মন্দির কার, নানা মত

কালীমন্দিরের পাশের যে মন্দিরটি রয়েছে, তাতে একটি পুরুষ ও একটি নারী মুর্তি রয়েছে। পাশাপাশি বাঘ, শিয়াল ও আরও কিছু বিগ্রহ আছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এটি শিব-পার্বতীর মন্দির। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, বিগ্রহ দু’টি ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর। তার একটা কারণ আনন্দমঠের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে এই এলাকায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছিলেন। তখন এলাকা রংপুর এস্টেটের অন্তর্গত ছিল বলে কারও কারও দাবি। এই দাবির সমর্থনে কিছু ঐতিহাসিকের গবেষণা ও দলিলও রয়েছে।

বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানী কে ?

বৈকুন্ঠপুর রাজবংশের এক বংশধর দর্পদেব রায়কত ১৭২৮ থেকে ১৭৯৩ সাল অবধি রাজত্ব করার সময় ভবানী পাঠক নামে এক সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে আসেন। রাজা দর্পদেবের উদ্যোগেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। রেমন্ড হিলাইচ নামে এক ইংরেজ স্থপতি মন্দিরটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। পরে ১৮৭১ সালে রাজা যোগেন্দ্রদেব রায়কতের আমলে মন্দিরটির সংস্কার করা হয়। এই মন্দিরই এই এলাকার মূল কিংবদন্তি। তার টানেই লোকে আসেন।

ডাকাত-সন্ন্যাসী ও তাঁর শিষ্যা

কিংবদন্তী রয়েছে, ভবানী পাঠক নিজে ডাকাত সর্দার ছিলেন। অনেকটা রবিনহুডের মতো। ডাকাতি করলেও নিজে সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করতেন। অত্যাচারী ইংরেজ ও দেশীয় জমিদারদের ওপর লুঠতরাজ চালিয়ে তা দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তাঁর সহযোগী ও শিষ্যা ছিলেন দেবী চৌধুরানী।

দেবী কি কাল্পনিক !

আবার অন্য মতে দুই ঐতিহাসিক চরিত্র বাংলাদেশের রংপুরের মন্থনী রাজ এস্টেটের সর্বময় কর্ত্রী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী নামে এক তেজস্বিনী মহিলা ছিলেন। তাঁকেই কল্পনায় দেবী চৌধুরানী হিসাবে রূপ দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তবে ইতিহাস যাই হোক স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিশ্বাসই সব।

পর্যটনের উদ্য়োগ ও স্বকীয়তা বজায়

আপাতত শিকারপুর চা বাগান কর্তৃপক্ষই এর দেখাশোনা করেন। কিছুদিন আগে মন্দিরটি পুড়ে গিয়েছিল। তারপর রাজ্য পর্যটন দফতরের তরফে সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এটাকে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে বেশি ঝাঁ চকচকে করতে গেলে গা ছমছমে একটা আলো-আঁধারি সঙ্গে প্রাচীণতার ইতিহাস যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে নজর দিতে অনুুরোধ করা হয়েছে।

 

Advertisement