ধামাখালি থেকে ভটভটিতে সন্দেশখালি পৌঁছতেই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন চোখে পড়ল। নৌকোগুলিতেও পুলিশ রয়েছে। ফেব্রুয়ারির রোদও ঝাঁঝাঁ করছে সুন্দরবনের এই দ্বীপ এলাকায়। সেখানকার একমাত্র বাজার ফেরিঘাট লাগোয়া। সেই ত্রিমনি বাজার থেকে পুকুরপাড়ায় যেতে হেঁটে মিনিট পনের লাগল। সন্দেশখালির দোকানপাট, সরকারি অফিস খোলা। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুই স্বাভাবিক। তাহলে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এই এলাকার সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
খোঁজখবর পেতে গেলে যেতে হবে পুকুর পাড়া, পাত্রপাড়া ও অরবিন্দ মিশন পাড়া এলাকায়। অল্প কথায় এমনটাই জানালেন একজন। কেউ প্রয়োজনের বাইরে কথা বলছেন না সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে। পুকুরপাড়ায় দিকে যেতেই চোখে পড়ল রেশনের দোকানে মহিলাদের ব্যাগ নিয়ে ভিড়। আশেপাশে দোকানপাট খোলা। পুকুরপাড়ায় বহু পুকুর আর ভেড়ি। সেখানকার মহিলারাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই দূর্নীতি করছিল তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ হাজরা ওরফে শিবু। যিনি শেখ শাহজাহানের আশীর্বাদধন্য। এই দেওয়াল লিখনও চোখে পড়ল। পাশাপাশি মহিলাদের ওপর যৌন হেনস্থা গুরুতর অভিযোগ। পার্টি অফিসে রাতে ডেকে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেক মহিলা। পুলিশেও ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু কোন মহিলদের সঙ্গে হয়েছে, তা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছিলেন না। একজন মহিলা বললেন, 'আপনারা পাত্রপাড়ায় চলে যান। সেখানকার মহিলাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।'
পাত্রপাড়া শুনসান। লোকজন সব ঘরে। পুরুষরা কেউ বাইরে বেরোলে গামছায় মুখ ঢাকছেন। আর মহিলারা ক্যামেরা দেখলেই ঘোমটা দিচ্ছেন। তিনজন মহিলা অভিযোগ করলেন, শেখ শাহজাহানের নির্দেশেই শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দার তাঁদের ওপর জুলুম করতেন। কাজ করিয়ে টাকা না দেওয়া। চাষের জমিতে জলকর (চাষের জমিতে ভেড়ি) করা। সেই বাবাদ টাকাও কম দেওয়া বা না দেওয়া। জব কার্ডের টাকা কেড়ে নেওয়া। বিভিন্ন প্রকল্প পেতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু সবথেকে বিস্ফোরক অভিযোগটি করলেন এক যুবতি। তিনি বললেন, তাঁকে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে পার্টি অফিসে। তিনি থানায় গিয়েছিলেন। অভিযোগ নেওয়া হয়নি। সেই অভিযোগপত্রটি অবশ্য তিনি দেখাতে পারলেন না। বাকি মহিলাদের বেশিরভাগই বললেন মহিলাদের হেনস্থা করা হয়েছে, তবে কাদের, তাঁরা জানেন না। তাঁরা অনেকের মুখে শুনেছেন বলে জানালেন।
ওই পাড়াতেই দেখা গেল পুরুষ ও মহিলা পুলিশকর্মী-সিভিক ভলান্টিয়াররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে আশ্বাস দিচ্ছেন। বলছেন ভয় পাবেন না। আমরা রয়েছে আপনাদের পাহাড়ায়। কেউ আপনাদের অনিষ্ট করতে পারবে না, ইত্যাদি। গ্রামের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় ত্রিপল খাটিয়ে পুলিশ দিনভর মোতায়েন রয়েছে। বহু মহিলা পুলিশও রয়েছে। ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকাতেও রয়েছে র্যাফ। কাঁদানে গ্যাসের শেল নিয়ে অপেক্ষা করছে বাহিনী।
শেখ শাহজাহানের একটি বাড়ি সরবেড়িয়া আকুঞ্জিপাড়ায়। কিন্তু সেই রাস্তার মোড়ে কোনও উর্দিধারীর দেখা মিলল না। দোকানপাট এবং মোড়ে বহু লোকজন। সেখানে গাড়ি ঢুকতেই প্রায় রে রে করে ছুলে এল জনাক'য়েক। পরিচয় জানতে চাওয়া হল। কেন এই রাস্তায়, 'এই রাস্তায় গাড়ি ঢুকবে না। সরু রাস্তা বের করতে পারবেন না', বলল জটলা থেকে বেশ লম্বা-চওড়া একজন। ততক্ষণে গাড়ির আশেপাশে এসে দাঁড়িয়েছে সাত-আটজন। তাদের আওয়াজে প্রচ্ছন্ন হুমকির সুর।
সূত্র জানাচ্ছে, শেখ শাহজাহানের একাধিক বাড়ি রয়েছে। সরবেরিয়া আকুঞ্জপাড়ায়, ধামাখালি, রাজারহাট, বরিরহাটে বাড়ি রয়েছে শেখ শাহজাহানের। এলাকায় তিনি বেশ জনপ্রিয়। বহু জায়াগায় তাঁর ফ্লেক্স ও পোস্টার রয়েছে। এমনকি তাঁর ফ্যানক্লাবও রয়েছে। প্রচুর ফ্যানের পাশাপাশি রয়েছে ভুরি ভুরি অভিযোগ। শাহজাহান মাছ রপ্তানি করেন। সন্দেশখালির বাগদা, ভেটকি, চিংড়ি দুবাই পর্যন্ত যায়। বাইকের স্টান্ট করতে পারেন। এলাকায় তাঁকে 'ভাইজান' সম্বোধন করেন ছোট-বড়রা।
৫ জানুয়ারি সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি। কিন্তু, ফিরতে হয়েছিল মার খেয়ে। উন্মত্ত জনতার রোষের মুখে পড়ে গিয়েছিল ইডি আধিকারিক থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। তারপর থেকেই নতুন করে খবরে উঠে এসেছে সন্দেশখালি। কিন্তু, এখনও খোঁজ নেই শেখ শাহজাহানের। সন্দেশখালিতে রোজই শাসক-বিরোধী দলের নেতারা যাচ্ছেন। হাওয়া গরম হচ্ছে। সেখানকার অভাবি পরিবারের লোকজনের অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিচ্ছেন তাঁরা। আসছে একাধিক কেন্দ্রীয় সংস্থা। তৈরি হচ্ছে রিপোর্ট। কিন্তু সম্পূর্ণ শান্তি ফিরছে না। সেখানকার মানুষ শান্তি চাইছেন।
বিকেল পাঁচটা। ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা স্বাভাবিক। দোকানপাট খোলা। মানুষজন ভটভটিতে পারাপার করছেন। চায়ের দোকান-হোটেল সবই খোলা। এই এলাকার ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা মুখ খুলছেন না। কদিন আগেও সেখানে কীর্তনের বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ফ্লেক্সে তৈরি সেই তোরণ এখনও রয়েছে ত্রিমনি বাজারের রাস্তায়। অশান্তির চোরাস্রোতের মধ্যেও মাঠে ছেলেরা হইহই করে ক্রিকেট খেলছে সন্দেশখালিতে।