
নিন্দুকেরা অনেক সময়ই বলেন, রাজ্যপাল নামক পদটি আসলে অলঙ্কারিক। ক্ষমতা বিশেষ নেই। সংবিধানের রক্ষাকর্তা হলেও ক্ষমতার রাশ হাতে থাকে না। শুধুমাত্র সরকার টলমল হলে বা পতন হওয়ার উপক্রম হলে রাজ্যপালের ভূমিকা সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্থায়ী সরকার গড়া বা টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এই মনোভাবটি গত কয়েক বছরে একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ধর্ষণ, রাজনৈতিক হিংসা সহ যে কোনও বড় অপরাধে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যপালরা নিজেরা যাচ্ছেন ও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছেন।
বাম আমলেও পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের ভূমিকা তেমন ভাবে চোখে পড়ত না। চিত্রটি বদলেছে গত কয়েক বছরে। তার আগে অবশ্য রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে বেশ সক্রিয় দেখা গিয়েছিল সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। পরবর্তীকালে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় খবরের শিরোনামে থেকেছেন সবচেয়ে বেশি। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালদের যতটা সক্রিয় ভাবে দেখা যায়, অন্যান্য রাজ্যে এতটা সক্রিয় কি থাকেন রাজ্যপাল? উত্তর খুঁজতেই এই প্রতিবেদন।
প্রথমে গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর দিকে আলোকপাত করা যাক। ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের দায়িত্ব নেন মহাত্মা গান্ধীর নাতি। তখন রাজ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী। ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যপাল ছিলেন গোপালকৃষ্ণ। বুদ্ধদেব তখন রাজ্যে শিল্প গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এদিকে জমি নীতি ঘিরে দানা বাঁধছে আন্দোলনও। যার মূল কাণ্ডারি ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম ইস্যুতে রাজ্যপালের ভূমিকা
এই দুই আন্দোলনের সময়কাল মোটামুটি ২০০৬ থেকে ২০০৮ বলা যায়। এমন দুটি আন্দোলন, যার ফলে বাম শাসনের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুটি আন্দোলনেই রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর ভূমিকা ছিল বেশ সক্রিয়। সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে সংযমী ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছিলেন তিনি। অশান্তি থামাতে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেন, শান্তিপূর্ণ সমাধানের আবেদন জানান। নন্দীগ্রামে ২০০৭ সালে যখন গুলি চলল, তারপর গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বলেছিলেন, 'What happened in Nandigram is a blot on the State.' অর্থাত্ নন্দীগ্রামে যা ঘটেছে, তা রাজ্যের কলঙ্ক। তত্কালীন বাম সরকারের উপর প্রবল চাপও সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। পরিস্থিতি শান্ত করতে একাধিকবার তাঁকে দেখা গিয়েছিল, মমতার সঙ্গে বৈঠক করতে। তবে সার্বিক ভাবে দেখে গেলে, সরাসরি তিনি কোনও রাজনৈতিক পদক্ষেপনা করলেও, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছিলেন শাসকদল বামেরা।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোট ও জগদীপ ধনখড়
২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের দায়িত্ব নেন জগদীপ ধনখড়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আবহে। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমঙ্গে সবচেয়ে সক্রিয় ও বিতর্কিত রাজ্যপাল। একেবারে প্রথম দিন থেকেই ধনখড়ের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত শুরু হয়ে যায়। জগদীপ ধনখড় নিজেই বলতেন, 'আমি কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট।'
অক্টোবর ২০১৯, দুর্গাপুজোর কার্নিভালে বিতর্ক
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আয়োজিত দুর্গাপুজো কার্নিভালে রাজ্যপাল ধনখড়কে মঞ্চে বসার জায়গা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। পরে তিনি প্রকাশ্যে বলেন, আমাকে অপমান করা হয়েছে। এখান থেকেই শুরু হয় রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী সংঘাতের প্রথম অধ্যায়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘেরাওয়ের মাঝখান থেকে বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করে আনেন। শিলিগুড়িতে প্রশাসনিক বৈঠক ডেকে, নাম না করেও বার বার এ রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ‘সীমা লঙ্ঘন’ না করার কথা মনে করিয়ে দেন। জিয়াগঞ্জ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করেন। দায়িত্ব নিয়ে মাত্র আড়াই মাসেই জগদীপ ধনখড় বুঝিয়ে দেন, তাঁর কার্যকালে খুব একটা স্বস্তিতে থাকবেন না পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল।
নভেম্বর ২০১৯ সাল, মুর্শিদাবাদ সফর ঘিরে চাপানউতোর
মুর্শিদাবাদের এক কলেজ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল ধনখড়ের। কিন্তু রাজ্য সরকার হেলিকপ্টার ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি সড়কপথে যান এবং অভিযোগ তোলেন, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় আমফান ও ত্রাণ দুর্নীতি
আমফান ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ বণ্টনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে রাজ্যজুড়ে। ধনখড় সরাসরি জেলা সফরে যান, আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মমতা সরকার অভিযোগ করে, রাজ্যপাল সংবিধানের সীমা লঙ্ঘন করেছেন।
বিধানসভা অধিবেশন ও প্রশাসনিক মন্তব্য
রাজ্যপাল ধনখড়ের নানা প্রশাসনিক মন্তব্যও বেশ বিতর্ক তৈরি করে। তিনি একাধিকবার বিধানসভার অধিবেশন, আইনপ্রণয়ন প্রক্রিয়া ও রাজ্য সরকারের কার্যপ্রণালী নিয়ে মন্তব্য করেন। এমনকি X হ্যান্ডেলে নিয়মিতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারের তীব্র সমালোচনা করতেন।
২০২১ সালের নির্বাচন ও ভোটপরবর্তী হিংসা
বিধানসভা নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গে একাধিক জায়গায় হিংসা,খুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রেও একেবারে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় ধনখড়কে। একাধিক হিংসাপীড়িত এলাকায় সফর করেন। এমনকী হিংসাকবলিত এলাকায় গিয়ে ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা বলা ও তাঁদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। একবার তো হিংসা পরিস্থিতি দেখে তাঁর চোখে জলও এসে গিয়েছিল। প্রকাশ্যে বলেন, 'Rule of law has collapsed in Bengal.' অর্থাত্ রাজ্যে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। রাজ্য সরকারকে 'Failure of constitutional machinery' বলেও মন্তব্য করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ ও রাজ্যপালের ভূমিকা
রাজ্যপাল হিসেবে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে উপাচার্য নিয়োগে হস্তক্ষেপ করেন। এর ফলেও শিক্ষা দফতরের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হয়। মমতা সরকার পরে রাজ্যপালের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য করার উদ্যোগ নেয়। ধনখড় নিজেই বারবার বলতেন, 'আমি পশ্চিমবঙ্গে সাংবিধানিক অভিভাবক'।
সিভি আনন্দ বোসও নানা ইস্যুতে সক্রিয়
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। জগদীপ ধনখড়ের পরে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এখনও দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে নানা ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছেন রাজ্যপাল বোসও। ২০২২ সালের নভেম্বরে রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নেন সিভি আনন্দ বোস। তারপরেই সরাসরি সংঘাত শুরু হয়ে যায় রাজ্য সরকারের সঙ্গে।
দুর্গাপুর ধর্ষণ কাণ্ড ও বোসের মুখে 'নবজাগরণ'
দুর্গাপুরে গিয়ে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় কোনও অজুহাত দেওয়া উচিত নয়। রাজ্যের সুরক্ষা দেওয়া উচিত। প্রত্য়েক নাগরিক, বিশেষ করে নারীদের পশ্চিমবঙ্গে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া বা বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। পশ্চিমবঙ্গে ফের নবজাগরণ প্রয়োজন।
২০২৩ সাল: রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বড় সংঘাত দেখা দেয় রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ ঘিরে। রাজ্য সরকার যেখানে নিজস্ব নিয়োগপদ্ধতি চালু করতে চেয়েছিল, বোস সেখানে রাজভবনের অনুমতি ছাড়া কোনও নিয়োগকে অবৈধ বলে মন্তব্য করেন। এর পর থেকেই শিক্ষা দফতর ও রাজভবনের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়।
কসবা 'ল কলেজের ধর্ষণ কাণ্ড
কলকাতার কসবায় 'ল কলেজে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে চলতি বছরের জুন মাসে। সেই ঘটনাতেও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে। গত ২৫ জুন কসবার আইন কলেজের ভিতরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। রাজভবন থেকে এই নিয়ে বিবৃতি জারি করা হয়। রাজ্যপাল জানিয়েছেন, কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতর এমন ভয়াবহ ঘটনায় তিনি উৎকণ্ঠিত। ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তা দত্ত দে-র সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রাখেন। একই সঙ্গে পড়ুয়াদের স্বার্থে উপাচার্যকে সমস্ত নিয়মবিধি মেনে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশও দেন।
সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন
২০২৩ সালের মে মাসে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তদারকি করতে দেখা যায় রাজ্যপাল বোসকে। কলকাতায় কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। তারপর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেহাল অবস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
২০২৪ সালে ভোটের আগে বোস একাধিকবার রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়েও তিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এখন প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালেরা নানা ঘটনায় যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন বলে দেখা যাচ্ছে, দেশের অন্যান্য রাজ্যেও কি একই রকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন রাজ্যপালের? উত্তর খোঁজা শুরু হল।