বুথের মৃত ভোটারদের তালিকায় নিজের নাম দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।জলজ্যান্ত মানুষ, অথচ সরকারি খাতায় ‘মৃত’। এমনই আজব অভিজ্ঞতা হল বাঁকুড়া শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাটপুর এলাকার বাসিন্দা আরতি সহিসের। রাজ্যে SIR (Special Intensive Revision) প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর নিয়ম মেনেই এনুমারেশান ফর্ম পূরণ করেছিলেন তিনি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একসঙ্গেই জমা পড়েছিল প্রয়োজনীয় নথি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তরফে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হতেই কার্যত মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আরতির পরিবারে। জীবিত আরতি সহিসের নাম নেই ভোটার তালিকায়। উল্টে তাঁর নাম উঠে এসেছে বুথের মৃত ভোটারদের তালিকায়।
ঘটনায় চরম উদ্বেগে দিন কাটছে পরিবারটির। কারণ শুধু ভোটাধিকার নয়, রেশন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সহ একাধিক সরকারি প্রকল্পের সুবিধা অব্যাহত থাকবে কিনা, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। ৫৮ বছর বয়সি আরতি সহিস জানান, তাঁর পরিবারের মোট ছ’জন ভোটার। SIR প্রক্রিয়ার সময় পরিবারের সকলেই একসঙ্গে ফর্ম পূরণ করেছিলেন। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, পরিবারের বাকি পাঁচজনের নাম থাকলেও তাঁর নাম উধাও। খোঁজ করতে গিয়েই বুথের মৃত ভোটারদের তালিকায় নিজের নাম দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
পরিবারের দাবি, কোনওভাবেই তাঁদের জানানো হয়নি যে আরতিকে মৃত হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। সংশোধনের সুযোগ বা নোটিস, কিছুই পাননি তাঁরা। ফলে হঠাৎ করে ভোটাধিকার হারানোর পাশাপাশি সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কিত গোটা পরিবার। আরতি সহিসের কথায়, “আমি তো বেঁচে আছি। তাহলে আমাকে কীভাবে মৃত বানিয়ে দেওয়া হল? ভোট দেওয়া তো দূরের কথা, রেশন বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যদি বন্ধ হয়ে যায়, আমরা চলব কীভাবে?”
এই ঘটনায় তীব্র রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে জেলায়। তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, সম্পূর্ণ দায় নির্বাচন কমিশনের। তাদের দাবি, ভুয়ো ভোটারের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই কমিশন পরিকল্পিতভাবে জীবিত মানুষকে মৃত দেখাচ্ছে। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, “SIR-এর নামে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এরই অংশ হিসেবে এই ধরনের মারাত্মক ভুল করা হচ্ছে।” শাসকদলের অভিযোগ, প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় কমিশন এড়াতে পারবে না।
অন্যদিকে বিজেপির পাল্টা দাবি, ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় স্থানীয় স্তরে গাফিলতির ফলেই এমন ঘটনা ঘটছে। গেরুয়া শিবিরের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরেই ভোটার তালিকায় অসঙ্গতির অভিযোগ রয়েছে। তার দায় শাসকদলও এড়াতে পারে না। যদিও এই নির্দিষ্ট ঘটনায় কমিশনের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে বলে মানছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
নির্বাচন কমিশনের তরফে এখনও পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে কোনও বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে নিয়ম অনুযায়ী খসড়া তালিকায় নাম বাদ পড়লে বা ভুলভাবে মৃত দেখানো হলে দাবি ও আপত্তি জানানোর সুযোগ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আরতি সহিস ও তাঁর পরিবার সেই প্রক্রিয়ায় আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। SIR-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এমন গুরুতর ভুল কীভাবে সম্ভব? জীবিত মানুষকে মৃত ঘোষণা করলে তার দায় নেবে কে? ভোটাধিকার রক্ষার পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের সুবিধা যাতে বন্ধ না হয়, সেই নিশ্চয়তা দেবে কে? বাঁকুড়ার এই ঘটনায় শুধু একটি পরিবারের দুর্ভোগ নয়, গোটা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজ্য জুড়ে।
সংবাদদাতা: নির্ভীক চৌধুরী