হ্যামার থ্রোয়ার থেকে গ্যাংস্টার হয়ে উঠেছিল শাপুরজির আবাসনে এনকাউন্টারে খতম দুষ্কৃতী জয়পাল সিং ভুল্লার। গত ৫ বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল জয়পাল। তার বিরুদ্ধে ছিল অপহরণ, ডাকাতি, বন্দুক কারখানা লুট-সহ একাধিক মামলা। সে এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে তার মাথার দাম ১০ লাখ টাকা রেখেছিল পুলিশ। জয়পাল সিং ভুল্লা কুখ্যাত গ্যাংস্টার ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু, তার থেকে কোনও অংশে কম যেত না কলকাতার গ্যাংস্টার সজল বারুই।
কে এই সজল বারুই? জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৯৩ সালে। দমদম থানা এলাকার বাসিন্দা সজল। তার বাবা সুবল বারুই। মা মিনতি বারুই। ওই দম্পতির ছেলে সজল। কিন্তু, সুবল আগে থেকেই বিবাহিত ছিল। তার স্ত্রীর নাম নিয়তি। জানা যায়, সুবল-নিয়তি-র এক ছেলেও ছিল। পরে সুবল মিনতিকে ছেড়ে ফের নিয়তির সঙ্গে থাকতে শুরু করে। সজলকে সেই বাড়িতে নিয়ে আসে। তখন সজলের বয়স মাত্র আট। সজল তার বাবা, সৎ মা এবং সৎ ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। তাদের হাতে অত্যাচারিত হতে থাকে। আর তাই কাল হয়ে ওঠে সজলের কাছে। তার গ্যাংস্টার ও খুনী হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হয় সেখান থেকেই।
২২ নভেম্বর, ১৯৯৩। তখন সজলের বয়স ১৬ বছর, ১১ মাস। কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে দোকান থেকে ভোজালি, গ্লাভস ও দড়ি কিনে আনে সজল। সেই সব নিয়ে বাড়িতে একাই ঢোকে। তার সৎ মা নিয়তি তখন বাড়িতে বসে টিভি দেখছিল। কিছুক্ষণ পরই একের একের পর এক বন্ধুরা সেখানে উপস্থিত হয়। তারা নিয়তিকে একটি চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। তারপর সজলের বাবা, ভাই ও মা'কে খুনের জন্য অপেক্ষা করতে থারে। এভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। একে একে বাড়িতে ঢোকে সজলের বাবা ও ভাই। ৩ জনকেই খুন করে সজল ও তার বন্ধুরা। তারপর ওই মৃতদেহের পাশে বসেই খাওয়া-দাওয়া করে। অলংকার-দামী জিনিস যা ছিল সব এক জায়গায় করে। 'দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক' নামে একটি অনুষ্ঠান হতো সে সময়। সেটি দেখেই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল কিশোর সজল। পরিকল্পনা মতো বন্ধুরা সজলকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ঘর থেকে চলে যায়। তিনটি মৃতদেহর সঙ্গে প্রায় ১২ ঘন্টা ঘরে কাটায়। তারপর চিৎকার করতে থাকে। প্রতিবেশীরা দেখেশুনে পুলিশকে খবর দেয়।
পুলিশ এসে দেখে, তিনটে মৃতদেহ পড়ে আছে। আর সজল চেয়ারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। সজল বলে তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তারাই খুন করেছে পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু, তদন্তকারীরা সজলের বয়ানকে বিশ্বাস করেননি। তাঁরা জেরা করতে থাকেন। জেরার মুখে ভেঙে পড়ে সজল। বলে আসল ঘটনা। সে পুলিশকে জানায়, সে ও তার বন্ধুরা মিলে মেরেছে ৩ জনকে। এর জন্য তার আফসোসও নেই। ওর কথার ভিত্তিতে পুলিশ বাকিদের গ্রেফতার করে। এরপর ব্যারাকপুর কোর্টে মামলা শুরু হয়। সজলকে ফাঁসির সাজা শোনান বিচারক।
কিন্তু, সজল থামার পাত্র ছিল না। সে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। আলিপুর জেলে সাজা কাটছে তখন সজল। সেখান থেকেই পালানোর ছক কষে। অসুস্থতার ভান করে সেখান থেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় । তারপর পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে চম্পট দেয়। এরপরই সজল হয়ে ওঠে গ্যাংস্টার। তাও এই শহরে নয়। সুদূর মুম্বইয়ে।
শোনা যায় মুম্বইয়ে একাধিক গ্যাংয়ের সঙ্গে কাজ করে সজল। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানিতে হাত পাকায়। সেখানেই সিল্কি নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তাকে বিয়ে করে। তবে মুম্বইয়ে বেশিদিন মন টেকেনি দমদমের সজলের। সেখানে হাত পাকানোর কাজ শেষ করে ফেরে কলকাতায়।
তখন সজলের বয়স ২৪-২৫। কলকাতায় এসে প্রথমেই নিজের নাম বদলে ফেলে। নাম রাখে কমল। কারণ, সেই কুখ্যাত সজলকে সবাই চিনত। কলকাতা, মেদিনীপুর-সহ একাধিক জেলায় সে শুরু করে ডাকাতি, অপহরণ, চুরি। একাধিক গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তার নামে থানায় বেশ কয়েকটি মামলাও দায়ের হয়। পুলিশ তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। কিন্তু, ধরা পড়েনি সজল।
এরপর ডাকাতি রাহাজানি করতে করতেই পুলিশের চোখে ধুলো দিতে নাম বদলে ফেলে। এবার হয় রাজু শেখ। কিন্তু, নাম বদলালেও শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আলিপুর জেলের জেলার মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে তখন বদলি হয়ে আসেন। তিনি চিনতে পারেন সজল ওরফে কমল ওরফে রাজুকে। সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে কুখ্যাত আফতাব আনসারির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। শোনা যায়, আনসারির সঙ্গে চক্রান্ত করছিল রাজু। পুলিশ সতর্ক হয়। সজলকে পাঠায় আলিপুর জেলে।
২০১০ -সালে হাইকোর্টে জামিন পায় সজল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে ফের ডাকাতি-রাহাজানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ফলে তাকে আবার জেলে যেতে হয়। তবে পরে ছাড়া পেয়ে মূলস্রোতে ফিরে আসে।
তবে এত কুখ্যাতি থাকলেও ছবি আঁকায় সুখ্যাতি ছিল সজলের। সে জেলে বসে বসেই ছবি আঁকত। যেগুলি পরে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে দেখানো হয়।
পুলিশ আধিকারিকদের অনেকেই বলছেন, জয়পাল সিং ভুল্লারকে নিয়ে এত আলোচনা-চর্চা হলেও সজলও কম বড় গ্যাংস্টার ছিল না। এত অল্প বয়সে তিন তিনজনকে একসঙ্গে খুন, জেল থেকে পালানো, মুম্বইয়ে একাধিক গ্যাংয়ের সঙ্গে কাজ আবার নাম বদলে কলকাতায় ফিরে ফের অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া- এ একমাত্র সজলের ক্ষেত্রেই সম্ভব ছিল। তখনকার দিনে এত সংবাদমাধ্যম ছিল না। কিন্তু, সজলের নাম লোকের মুখে মুখে ফিরত।
কুখ্যাত গ্যাংস্টার সজলকে নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল বললেন, 'সে সময় কলকাতায় গ্যাংস্টার ছিল। আমার যেখানে বাড়ি সেই হাওড়াতেও গ্যাংস্টারদের দাপট ছিল। তারা এলাকা দখল বা স্মাগলিং নিয়ে নিজেদের মধ্য়ে মারামারি করত। সাধারণ মানুষের জীবনে তার প্রভাব পড়ত না। কিন্তু, সজল বারুই সবাইকে যেন জোর ধাক্কা দিয়েছিল। দিনের পর দিন খবরের কাগজের হেডলাইন দখল করে রাখত সজল। অত অল্প বয়সের একজন ছেলে পরিবারের ৩ জনকে হত্যা করল! তখন ভাবা যেত না এসব। আর সজল তো স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। লেখাপড়া করত, ছবি আঁকায় ভালো হাত ছিল, সে খুন করল কীভাবে সেটাই ছিল রাজ্যের মানুষের প্রধান আলোচনার বিষয়। আর শুধু যে খুন করেই ক্ষান্ত থাকল তা নয়, জেল থেকে পালাল, তারপর একাধিকবার ধরা পড়ল, জেল থেকে বেরিয়ে ফের গ্যাংস্টার ইমেজ বজায় রাখল, এমন উদাহরণ কমই দেখেছি। আমাদের রাজ্যে সজলের মতো গ্যাংস্টার খুব কমই দেখেছি।'