scorecardresearch
 

Abhishek Banerjee: অভিষেকের 'জনসংযোগ যাত্রা' আজ শেষ, কী লাভ হল?

এই সফরটা কিন্তু সুপরিকল্পিত। এই সফরটা অনেক ভাবনা চিন্তা করে করা হয়েছে। অতীতে যেরকম সিপিএম একটা সময়ের পর আত্মসমালোচনার ভঙ্গিতে আত্মশুদ্ধি এবং প্রকাশ‍্যে নানা রকমের কর্মসূচি গ্ৰহণ করেছিল। যেখানে বলা হত, পুরোনো সিপিএম থেকে নতুন সিপিএম তৈরি হবে।

Advertisement
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-- ছবি: PTI অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-- ছবি: PTI

তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের নবজোয়ার যাত্রা আজ শেষ হচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ইতিমধ্যেই ঘোষণা হয়ে গেছে এবং পঞ্চায়েত ভোটে এই নবজোয়ার যাত্রার প্রভাব কী পড়বে, আর কী পড়বে না সেটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে।

প্রথমে কথা ছিল, পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে মে মাসে। সাধারণত পশ্চিমবঙ্গে মে মাসেই পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন মে মাসে হওয়ার আগেই অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তাঁর এই জেলাওয়াড়ি সফরসূচি ঘোষণা করে দেন। প্রথমে যেটা ছিল শুধু একমাসের। সেটা ক্রমশ আরও বাড়তে থাকে। অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এটাও ঘোষণা করেছিলেন, তিনি কলকাতায় আসবেন না। তিনি একনাগাড়ে জেলাগুলোতে ঘুরবেন। অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের এই জেলাসফর শুরু হওয়ায় একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, তাহলে কি পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে? অনেকে এমনটাও ভাবতে শুরু করেছিলেন, যার মধ্যে বিজেপি এবং সিপিএমের কিছু নেতাও ছিলেন, তা হল, হয়তো পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন এখন আর হবে না। আনুষ্ঠানিকভাবে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ভোট করতে হবে এমনটাই একটা সাংবিধানিক রীতি ছিল। কিন্তু যেহেতু পঞ্চায়েত নির্বাচনটা দিল্লির নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারে পরে না, এটা পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় নির্বাচন অফিসের মাধ্যমে হয়, তাই এটা রাজ‍্য সরকার চাইলে আরেকটু পিছতে পারে এমন যুক্তি পাল্টা যুক্তিও ছিল।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কমিশনার কে হবেন, সেই বিতর্কটাও তার মধ্যে এসে যায়। রাজ‍্যপাল একমাস ধরে ফাইলটা আটকে রাখেন। তারপর শেষ পর্যন্ত রাজীব সিনহাকেই করা হয় কমিশনার। এই টানাপোড়েনের মধ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেয় রাজ‍্য সরকার। অভিষেকের জনসভাও যেমন চলার তেমন চলতে থাকে। এবারে জনসভা যখন আজ শেষ হচ্ছে তখন প্রশ্ন উঠেছে কী লাভ হল আর লোকসানই বা কী হল?

আরও পড়ুন

অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের এই সফরে অবশ‍্য তৃণমূলের শুরুতেই পঞ্চায়েতের প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। শুরুর দিনেই অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বলে দেন, পঞ্চায়েতে প্রার্থী হওয়া নিয়ে কোনও সুপারিশ, কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করা হবে না। স্থানীয় মানুষরা যাঁদের চাইবেন, যাঁদের পরিচিতি ভাল, যাঁরা অতীতে পঞ্চায়েতে থেকে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করেনি বলে মানুষ মনে করেন, তাঁদেরকে প্রার্থী করা হবে। এবং তার জন্য মানুষের ভোট নেওয়া হবে। দলের নেতারা সেটা ঠিক করবেন তা নয়। মানুষের অভিমত সংগ্ৰহ করে প্রার্থী করা হবে।

Advertisement

এই প্রক্রিয়া নিয়ে রীতিমতো দলের মধ্যের পুরোনো গোষ্ঠীরা ক্ষেপে ওঠে। বিদ্রোহ হয়। কিন্তু অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তিনি তাঁর এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে কোন এলাকায় কোন গ্ৰামে ভাল প্রার্থী, খারাপ প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের এই পুরো সফরের আসল যে বার্তাটা দিতে চাইলেন, সেটা হল একটা নতুন তৃণমূল কংগ্রেসকে তিনি গঠন করতে চাইছেন। সেটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসতে চাইছেন। সেই তৃণমূল কংগ্রেস এই এতদিনের দশ বছরের ক্ষমতায় থাকার ফলে যে সমস্ত বেণোজল ঢুকেছে, যেসব জায়গায় নানা রকমের বিচ‍্যুতি দেখা দিয়েছে। সেই জায়গাটা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একটা নবীন প্রজন্মের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। একটা আধুনিকমনস্কতা আসবে। এবং নিঃশব্দে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্য়ায়ের নেতৃত্বের একটা উত্তরাধিকার এই সফরের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে।

সুতরাং এই সফরটা কিন্তু সুপরিকল্পিত। এই সফরটা অনেক ভাবনা চিন্তা করে করা হয়েছে। অতীতে যেরকম সিপিএম একটা সময়ের পর আত্মসমালোচনার ভঙ্গিতে আত্মশুদ্ধি এবং প্রকাশ‍্যে নানা রকমের কর্মসূচি গ্ৰহণ করেছিল। যেখানে বলা হত, পুরোনো সিপিএম থেকে নতুন সিপিএম তৈরি হবে। একটা উন্নততর বামফ্রন্ট তৈরি হবে। ঠিক সেইরকম ভাবেই অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তৃণমূল কংগ্রেসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একটা রাজনৈতিক বার্তা শুধু নয়। একটা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকেও সাধারণ মানুষের কাছে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টাইলে গ্ৰামে-গঞ্জে গিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেয়েছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। যেখানে যেখানে বিক্ষোভ হয়েছে যেসব ইস‍্যু নিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তিনি ঠান্ডা মনে কথা বলেছেন। সেটা কখনও উপজাতিদের সমস্যা। কখনও মতুয়াদের এলাকায় গিয়ে তিনি শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে বিজেপির বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েও তিনি সেখানে বার্তা দিয়েছেন, তিনি কিন্তু মতুয়াদের আরাধ্য দেবতা এবার মতুয়া মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য থেকেই সরে আসছেন না।

এখন প্রশ্ন হল, অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের এই প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে? যারা অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সমালোচক তারা বলছেন, মমতা মমতা। অভিষেক অভিষেক। অভিষেক কখনও মমতার বিকল্প হতে পারেন না। অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তাঁর নিজের রাজনৈতিক কতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু তার মধ্যে সেই স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব আছে, যেটার অভাব মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মধ্যে হয় না। কিন্তু অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সমালোচকরা যা-ই বলুন, এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের জেলাওয়াড়ি সফরে যেভাবে মানুষের ঢল নেমেছে, যেভাবে কাতারে কাতারে মানুষ যোগ দিয়েছে, এবং প্রত‍্যেকটা জায়গায় গিয়ে অভিষেক গাড়ি থেকে নেমে, অনেকসময় গাড়ির মাথায় উঠে বসেছেন, কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে, হেঁটেছেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, এই প্রচন্ড গরমের মধ‍্যেও তিনি যে একজন অলস, আরামপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা নন সেটাও কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের এই সফর তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে সুবিধেই এনে দেবে। তার থেকে অনেক রাজনৈতিক ফায়দাই তৃণমূল কংগ্রেস পাবে এমনটাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। 

যদিও বিজেপি কিন্তু এই সময় অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কেই প্রধান টার্গেট করছে। যেহেতু এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট আর সিবিআই অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের স্ত্রীকে জেরা করেছে, তাঁর ব‍্যাঙ্কক যাওয়া আটকে দিয়েছে। এর ফলে বিজেপিও কিন্তু অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচারটাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। মমতার চেয়েও যেন অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তাদের কাছে বড় টার্গেট হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের চিত্রটাও কিন্তু এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের মরশুমে আরেকবার স্পষ্ট হয়ে উঠল।

Advertisement

Advertisement