পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই সংখ্যালঘু সমাজে ফুরফুরা শরিফের প্রভাব কতটা গভীর, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন বৃথা। বহু বছর ধরে ফুরফুরা শরিফের বিভিন্ন পীরজাদা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে এসেছেন। কখনও সরাসরি, কখনও পরোক্ষে—এই প্রভাব ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কৌশলে। আর এবার এই জায়গায় এক নতুন নাম সামনে আসছে, কাশেম সিদ্দিকী।
কে এই কাশেম সিদ্দিকী?
কাশেম সিদ্দিকী ফুরফুরা শরিফের আরেক পীরজাদা। এতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিসরে তাঁকে খুব বেশি দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় এবং তারপর থেকে রাজ্য সরকারের সমালোচনায় তিনি একাধিকবার সরব হয়েছেন। সিপিএম-এর সঙ্গে তাঁর একসময় ঘনিষ্ঠতা ছিল বলেও নানা মহলে আলোচনা হয়েছিল। তুতো ভাই আব্বাস সিদ্দিকী যখন ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (ISF) গঠন করেন, তখন কাশেম তাঁকে সরাসরি সমর্থন করেন। এমনকী নওশাদ সিদ্দিকীকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, কাশেম সিদ্দিকী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। এইসব ঘটনার পর হঠাৎ করে কাশেমকে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যাওয়ায় রাজনৈতিক মহলে চোখ কপালে উঠেছে।
কাশেম সিদ্দিকীকে কেন তৃণমূলে?
তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সম্প্রতি কাশেম সিদ্দিকীকে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করা হয়েছে। তৃণমূলের প্রেস বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। দলীয় নেতাদের মতে, রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজে নতুন করে একটি প্রভাবশালী মুখ তুলে আনতেই কাশেমকে সামনে আনা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে তৃণমূলের কৌশল স্পষ্ট, ত্বহা সিদ্দিকীর ভূমিকা ও গ্রহণযোগ্যতা বর্তমানে কিছুটা দুর্বল। সেই ফাঁক埡 পূরণ করতেই কাশেমকে সামনে আনার পরিকল্পনা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ফুরফুরা শরিফে ‘ঠাকুরনগর মডেল’?
বিজেপি যেভাবে ঠাকুরনগরে মতুয়া ভোট ধরে রাখতে ঠাকুরবাড়ির দুই শিবিরকে ব্যবহার করছে—একদিকে শান্তনু ঠাকুর, অন্যদিকে মমতাবালা ঠাকুর—ঠিক একই ছক কি এবার তৃণমূল আনছে ফুরফুরা শরিফে? একদিকে ত্বহা সিদ্দিকী, অন্যদিকে কাশেম সিদ্দিকী—দুই শিবিরের দ্বৈরথে কি রাজনৈতিক সুবিধা তুলতে চাইছে ঘাসফুল শিবির? ত্বহা সিদ্দিকী ইতিমধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'যে নবান্নকে সবাই চোর বলেছিল, সেই লোকই এখন মমতার পাশে।' তিনি অভিযোগ করেন, ফুরফুরাকে মতুয়াদের মতো ব্যবহার করতে চাইছে কেউ কেউ, কিন্তু তা সফল হবে না।
এর পাল্টা কাশেম সিদ্দিকী বলেন, 'ফুরফুরায় কোনও সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে একজনই। যিনি সবসময় চিৎকার করেন। তিনি কালো চশমা পরে থাকেন, তাই হয়তো সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পান না।'
নির্বাচনের আগে নতুন অঙ্ক
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ঘিরে আবার নতুন করে জোর দিচ্ছে তৃণমূল। মুসলিম ভোটবিভাজন যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে চাইছে দল। আব্বাস ও নওশাদের আইএসএফ যেভাবে সংখ্যালঘু ভোট কেটে নিয়েছিল ২০২১-এ, তা থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার আরও আগেভাগে প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল। এই প্রেক্ষাপটে কাশেম সিদ্দিকীর উত্থান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ফুরফুরা সফরে তাঁকে পাশে দেখা গেছে কাশেমকে, যেখানে ত্বহা কিংবা আব্বাস-নওশাদ ছিলেন না। পার্ক সার্কাসের ইফতারেও একই ছবি।
ত্বহার প্রভাব কি কমছে?
ত্বহা সিদ্দিকী বরাবর তৃণমূলপন্থী ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূলের অন্দরেও মনে করা হচ্ছে, তাঁর সঙ্গে কাজ করা সহজ নয়। কাশেম সিদ্দিকী সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন কি না, তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে আপাতত তৃণমূল পরিষ্কারভাবে বার্তা দিচ্ছে—ফুরফুরা শরিফে নতুন মুখ, নতুন ভরসা কাশেম সিদ্দিকী।
আর এই সিদ্ধান্তই সম্ভবত বদলে দিতে চলেছে ফুরফুরার রাজনীতি।