শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা? বলাই যায়। বন্যার জেরে ঠিক কী অবস্থা লিবিয়ার, তার মালুম হচ্ছে ডেরনা নামক এই শহরটির পরিস্থিতি দেখে। ডেরনার সব সভ্যতাই গ্রাস করেছে ভূমধ্যসাগর। মানুষ, গাড়ি, ঘর-বাড়ি, পশু-- যা কিছু সব গিলেছে ভূমধ্যসাগর। সব ছবি সৌজন্য: AP ও রয়টার্স
বাঁধ ভেঙে জলের তোড় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আস্ত গাড়িকেও সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের উপরে তুলে দিয়েছে। ডেরনা শহরে ধ্বংসাবশেষ বাড়িগুলিতে কাদা, মাটি ভর্তি। মানুষের আতঙ্ক, এই কাদা-মাটির মধ্যেই হয়তো রয়েছে নিকট মানুষের দেহ। ঘটছেও তাই।
শহর থেকে বেরিয়ে একের পর গাড়ি ভূমধ্যসাগরে পড়ে রয়েছে। লাশগুলিকে ভাল করে চেনাও যাচ্ছে না। সবই গিলেছে সমুদ্র।
যে কটি দেহ উদ্ধার হয়েছে, তাতে এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ৩০০। ১০ হাজারের বেশি মানুষ এখনও নিখোঁজ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আশঙ্কা, মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই বাড়তে পারে।
নিখোঁজরা জলভাসি বন্দরশহর ডেরনা শহরের কোথায় রয়েছেন তাঁরা, কী ভাবে রয়েছেন, কিছুই জানতে পারছে না প্রশাসন। ডেরনা-য় সাধারণ নাগরিকের প্রবেশাধিকার বন্ধ করল লিবিয়া সরকার। শুধুমাত্র উদ্ধারকর্মী ও ত্রাণের কাজে থাকা কর্মীরাই সেখানে যেতে পারবেন।
এহেন সময়ে আরও একটি বিষয় ভাবাচ্ছে। তা হল, বন্যা পরবর্তী রোগ। যে কজন বেঁচে রয়েছেন, তাঁরা এখন ডেরনা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যুদ্ধের লিবিয়ায় বহু জায়গায় বারুদে ঠাসা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। সেগুলিও ভেসে গিয়েছে।
এখনও পর্যন্ত এক হাজারের বেশি দেহ কবর দেওয়া হয়েছে। বহু মানুষ ভূমধ্যসাগরে জলের সঙ্গে ভেসে আসা নানা বিষাক্ত জিনিসেও মারা গিয়েছেন।
বেনগাজি থেকে আসা মেডিক্যাল পড়ুয়ারা ডেরনা শহরে সংক্রামক রোগ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য গোটা শহরে ওষুধ ছড়াচ্ছেন।
কম করে হাজারটি বাড়ি হড়পা বানে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ডেরনা শহরের মেয়রের দাবি, কম করে ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি কর্মী মহম্মদ আলনাজি বুশহরদিলা জানাচ্ছেন, তাঁর পরিবারের ৪৮ জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তিনি একা বেঁচে রয়েছেন।
মাল্টা থেকে আসা উদ্ধারকারী দল ডেরনা শহরের উপকূলে কয়েকশো দেহের হদিশ পেয়েছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, সমুদ্রের তটে একসঙ্গে ৪০০ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে শিশু ও মহিলাও রয়েছে।
ডেরনা শহরে কম বেশি দেড় লক্ষ মানুষের বসবাস ছিল। গোটা শহরটি এখন বিলুপ্ত সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। কাদা-মাটি সরালেই মিলছে লাশ।
ডেরনায় ১৯৭০ সালে যুগোস্লোভিয়ার একটি সংস্থা বাঁধ নির্মাণ করেছিল। সেই ৭৫ মিটার উঁচু ছিল। সেই বাঁধে ১.৮০ কোটি কিউবিক মিটার জল থাকত। আরেকটি ৪৫ মিটার উঁচু বাঁধে ১৫ লক্ষ কিউবিক মিটার জল জমা হত। সব মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি টন জল। ওই দুই বাঁধ রক্ষা করত ডেরনা শহরকে।
রবিবার ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে উপকূলীয় শহর ডেরনা এবং লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজির উপর। ডেরনার এক বাসিন্দা আহমেদ মহম্মদ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, 'আমরা তখন ঘুমোচ্ছিলাম। গোটা শহর তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম ভাঙতেই দেখি বা়ড়ির চারপাশ দিয়ে জলের স্রোত বইছে। সে কী ভয়ঙ্কর স্রোত। সেই জল ১০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছ গিয়েছিল। আমরা বেরোনোর চেষ্টা করেও পারিনি। শেষে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিই।'