
নেপাল এবং ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তবে সেই সম্পর্কে এখন মরচে পড়ে গিয়েছে। কারণ চিন ধীরে ধীরে নেপালের কাছাকাছি আসা শুরু করেছে। পরিকাঠামো উন্নয়নের নাম করে নেপালে কার্যত জাঁকিয়ে বসেছে শি জিনপিংয়ের দেশ। ফলে আন্তর্জাতিক মহলের একাংশেরক অনুমান, নেপাল আজকাল চিনের ইশারাতেই চলে। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সদ্য ইস্তফা দেওয়া কেপি শর্মা ওলির বিরুদ্ধে চিনের অঙ্গুলিহেলেন চলার অভিযোগ রয়েছে। দেশ উত্তাল হতেই তিনি ইস্তফা দিয়ে নিরুদ্দেশ।
বর্তমানে বালেন্দ্র ওরফে বালেন শাহ নেপালের রাজনীতিতে উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে তাঁর বসার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। চিরাচরিত রীতিনীতি ভেঙে রাজনীতিতে আসা এই বালেন শাহ ভারতের বিরুদ্ধে একাধিকবার বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
২০১৫ সালের আশপাশেই ভারত এবং নেপালের সম্পর্কে খানিকটা চিড় ধরা পড়েছিল। সে বছরই নেপালে সংবিধান লাগু হয়। যেখানে মাধেশি সম্প্রদায়ের অভিযোগ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। মাধেশি সম্প্রদায়ের অসন্তোষের ফল ভারতের সীমান্তেও এসে পড়ে। এর ফায়দা তুলতে পারে চিনও। এই আশঙ্কা থেকেই নয়াদিল্লি কাঠমান্ডুর কাছে আর্জি জানিয়েছিল, যাতে তারা নিয়মকানুন নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবনাচিন্তা করে। সে আর্জি রাখেনি নেপাল বরং বিষয়টিকে সীমান্তে ভারতের দখলদারি হিসেবে দেখা হয়। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন রয়েছে।
সুযোগ বুঝে সেই ফাঁকে নেপালে এন্ট্রি নিয়ে ফেলে চিন। সেখানে সড়ক, এনার্জি সেক্টরে বড়সড় বিনিয়োগ করতে শুরু করে। চিন এবং নেপালের মধ্যে এভাবেই কূটনৈটিক সম্পর্ক মজবুত হয়।
চিনের কাছে সেটাই সুযোগ ছিল, ভারতের একটি ভাল প্রতিবেশী দেশকে নিজের বশে করে নেওয়া। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন চলাকালীনই বেজিংয়ের কাছাকাছি আসে কাঠমান্ডু। তাদের একটি শক্তিশালী দেশের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। সেখান থেকেই আসল সমস্যার সূত্রপাত। সাহায্যের বিনিময়ে অন্তর্বর্তী বিষয়ে নাক গলানোর স্বভাব নতুন নয় চিনের। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তা কিংবা সুদূর আফ্রিকাতেও নাক গলানোর অভিযোগ রয়েছে চিনের বিরুদ্ধে। চিন থেকে সাহায্য পেতে পেতে নেপালের নেতারা ধনী থেকে ধনীতম হয়ে ওঠেন। তাদের সন্তানরা বিদেশে বিলাসবহুল জীবন কাটাতে শুরু করে। সেখানে সাধারণ নেপালি জনতা মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্নীতিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছিল।
নেতা এবং তাদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেপালে দীর্ঘদিন ধরেই রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছিল। তবে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ অন্যরকম। দু'দিনেরও কম সময়ের মধ্য যুব বিক্ষোভকারীরা রাজনীতিতে ঢুকে গেল। বিশেষ করে জেন জি গোটা প্রদশর্নের নেতৃত্বে ছিল।
জেন জি-এর পছন্দের নেতা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তথা ব়্যাপার বালেন শাহ। নির্দলে জিতে তিনি বর্তমানে কাঠমান্ডুর মেয়র। দুর্নীতি বিরোধী নেতা হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে নেপালে। মুক্তমনা নেতা হিসেবে বালেন শাহ জেন জি-র মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কি পূর্বসূরি কেপি ওলির থেকে আলাদা হবেন?
২০২৩ সালে বালেন নিজের কাঠমান্ডুর দফতরে গ্রেটার নয়ডার একটি ম্যাপ লাগিয়েছিলেন। সেখানে ভারতের কিছু কিছু এলাকা নেপালের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখানো হয়েছিল। যা রাজনৈতিক স্ট্যান্ট বলেই মনে করা হয়েছিল। যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে বালেন শাহের মানসিকতার খানিকটা ইঙ্গিত মিলেছিল।
'আদিপুরুষ' সিনেমাটিতে একটি ডায়লগ ছিল, 'সীতা ভারতের মেয়ে।' বালেন শাহ এটিকে নেপালের সাংস্কৃতিক পরিচিতিতে আঘাত বলে মনে করেন। এই সিনেমাটিকে তিনি কাঠমান্ডুর হলগুলিতে রিলিজ করা নিষিদ্ধ করে দেন। এমনকী তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় সে সময়ে লিখেছিলেন, 'ভারত সংস্কৃতির নাম করে নেপালের অন্দরে নাক গলাচ্ছে।'
বালেন এমনিতে খুব মেপে কথা বলেন। খোলাখুলি সংঘাতে জড়াতে চান না। তবে কোথাও না কোথাও তিনি ভারতের প্রতি সামান্য হলেও আক্রমণাত্মক। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে জোর দিতে পারেন কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিচিতি নিয়ে তাঁর মনোভাব বেশ কঠোর। যা ভারত-নেপাল সম্পর্ক আরও জটিল করে করবে।
অন্যদিকে, তিন নিয়ে বালেন শাহ অনেক বেশি সতর্ক। নেপালে চিন অত্যধিক বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে নেপালের মানুষের প্রয়োজন কর্মসংস্থান এবং অর্থ। যা বেজিং পাশে থাকলে তবেই সম্ভব। আর সে কারণেই তিনি বেজিংয়ের বিষয়ে কথা বলার সময়ে খানিকটা সতর্ক থাকেন, যা নয়াদিল্লির বেলায় থাকেন না। তবে চিনে উপরও অসন্তোষ কম নেই তাঁর। একবার চিন নেপালের ভুল মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। তারপর নিজের চিন সফর বাতিল করে দিয়েছিলেন বালেন। নিজের ব়্যাপেও তিনি দুর্নীতি এবং চিনা বিনিয়োগকে কটাক্ষ করেছেন। তবে সে ইস্যুগুলি তেমন বড় হয়নি। বর্তমানে বালেন বিদেশ নীতি নিয়ে অত্যধিক সতর্ক।