মার্চ মাসে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড জানিয়েছিলেন, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে না। মঙ্গলবার তা নিয়ে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'গ্যাবার্ড কী বলেছেন তাতে কিছু আসে যায় না। ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।'
বৃহস্পতিবার রাতে ইরানে সবচেয়ে বড় হামলা করে ইজরায়েল। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হামলার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। ইজরায়েলের দাবি, ইরান পারমাণু বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট ইউরেনিয়ামের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। শীঘ্রই তারা পারমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে। যদিও ইরান বরাবরের মতো এবারও সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইরান একাধিকবার জানিয়েছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচির লক্ষ্য বেসামরিক। বোমা তৈরির কোনও উদ্দেশ্য নেই। এর আগে ইরান আমেরিকার সঙ্গে পারমাণু চুক্তির জন্য আলোচনাও করছিল। সেখানে আমেরিকা সাফ করে দিয়েছিল, ইউরেনিয়াম ধ্বংস করতে হবে ইরানকে। যদিও আয়াতুল্লা খামেনির দেশ সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তারপরই ইজরায়েল ইরানে আক্রমণ করে।
এখন প্রশ্ন ইরান কি সত্যিই পরমাণু বোমা তৈরি করছে বা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে? নাকি এটা কেবলই আমেরিকার কল্পনা? ইরাকের ক্ষেত্রেও আমেরিকা দাবি করেছিল সাদ্দাম হোসেন বিপজ্জনক রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র মজুত করছে। তারপর ইরাকে আক্রমণও চালানো হয়। তবে, সেখানে তেমন কোনও অস্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তুলসী গ্যাবার্ডের পর IAEA এর প্রধানও পরমাণু অস্ত্রের তত্ত্ব খারিজ করেছেন
চলতি বছরের ২৫ মার্চ আমেরিকার গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড সংসদে জানিয়েছিলেন, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে না। সেই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, 'গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ইরান পারমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। খামেনি ২০০৩ সালে পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন। সেই নির্দেশই বহাল রেখেছেন।' আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসিও জানিয়েছেন, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে এমন কোনও প্রমাণ তাঁদের সংস্থার কাছে নেই।
১৯৯৬ থেকে নেতানিয়াহু দাবি করছেন ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে
সেই ১৯৯৬ সাল থেকে ইজরায়েল প্রধান বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবি করে আসছেন, ইরান তিন মাসের মধ্যে পরমাণু বোমা তৈরি করবে। ইরানের উপর হামলার সময় নেতানিয়াহুর একটি ভিডিও সামনে এসেছিল। সেখানে দেখা যায়, ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির দাবি করছেন তিনি। সিএনএন প্রকাশিত একটি ভিডিওতে, নেতানিয়াহুকে ১৯৯৬ সালে বলতে দেখা যায়, 'ইরান তাদের লক্ষ্যের খুব কাছে চলে এসেছে।' আবার ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের একটি ভিডিওতে, তিনি একই দাবি করেছিলেন। ২০১৫ সালের মার্চের একটি ভিডিও ক্লিপে নেতানিয়াহুকে বলতে শোনা যায়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ইরান পারমাণু বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করে ফেলবে। একই বছরের অক্টোবরেও একই দাবি করেছিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, নেতানিয়াহু কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন, ইরান সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে পরমাণু বোমা তৈরি করবে। কিন্তু সেই সপ্তাহ বা দিন শেষ হচ্ছে না। aajtak রেডিওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, তুরস্কের আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডঃ ওমাইর আনাস বলেন, '১৯৯৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নেতানিয়াহু ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির দাবি করে আসছে। নেতানিয়াহুর লক্ষ্য হল, তাঁর নিজের দেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখা।' ডঃ আনাস ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খামেনির ফতোয়ার কথাও মনে করিয়ে দেন। বলেন, 'খামেনি সাহেবের একটি ফতোয়া আছে... তিনি আগেই জানিয়েছেন, এই ধরনের বোমা রাখা ইসলামের বিরুদ্ধে।'
পরমাণু বোমা নিয়ে খামেনির ফতোয়া
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি পারমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে তিনি এই অস্ত্রের বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারিও করেছিলেন। ২০০৩ সালে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, ইরান এমন অস্ত্র তৈরি করবে না। তা সংরক্ষণ ও ব্যবহার করবে না। কারণ, এই অস্ত্র ইসলামী নীতির পরিপন্থী। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) এর সিনিয়র কমান্ডাররা খামেনিকে তাঁর ফতোয়া প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছিলেন।
ইরানে কি ইরাকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে?
আমেরিকা ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাক আক্রমণ করে। আমেরিকা ও ব্রিটেন সেই সময় দাবি করেছিল, ইরাকের কাছে রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র রয়েছে। সেই অস্ত্র মানব জাতির অকল্যাণ করতে পারে। তারা পরমাণু বোমা তৈরির দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর মে মাসে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও ইরাকে অস্ত্র থাকার কোনও প্রমাণ মেলেনি। তার জেরে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে জানা যায়, ইরাকে আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র থাকার বিষয়টি প্রচার করা হয়েছিল মাত্র। আসলে কোনও অস্ত্র কোনওদিনই ছিল না। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকের মনে প্রশ্ন, ইরানেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না তো?