Nimisha Priya: আর মাত্র ৬ দিন পরেই শরিয়ত আইনে ফাঁসি, ইয়েমেনে ভারতীয় মহিলার নির্মম কাহিনি

২০১২ সালে জন্ম হল তাঁদের মেয়ে। নতুন অতিথি যেন আলো এনে দিল জীবনে। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে ছোট শিশুকে মানুষ করা সহজ ছিল না। আর্থিক সমস্যাও মাথাচাড়া দিল। টমি ঠিকমতো চাকরিও পাচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে ২০১৪ সালে তিনি মেয়েকে নিয়ে কেরলে ফিরে এলেন। নিমিষা থেকে গেলেন ইয়েমেনে।

Advertisement
আর মাত্র ৬ দিন পরেই শরিয়ত আইনে ফাঁসি, ইয়েমেনে ভারতীয় মহিলার নির্মম কাহিনিনিমিষা প্রিয়া
হাইলাইটস
  • ঠিক কী ঘটেছিল নিমিষার সঙ্গে?
  • হাসপাতালেই পরিচয় হয়েছিল
  • আশেপাশে কেউ নেই, আত্মীয় স্বজন হাজার মাইল দূরে

সালটা ২০০৮। কেরলেন কিশোরী ১৯ বছরের নিমিষা প্রিয়া মাকে দেখত, লোকের বাড়িতে রোজ কাজ করতে যাচ্ছেন। নিমিষা ভাবত, একদিন এই দারিদ্র ঘুচবেই। মা প্রেমা কুমারী দিনরাত কাজ করতেন, মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতেন। তবু মেয়ে যেন ‘কিছু একটা হয়’, সেই স্বপ্ন কখনও ছেড়ে দেননি। পরিবারের অবস্থা ফেরাতে সে ইয়েমেন চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নার্সিং করেছিল নিমিষা। কেরল থেকে অনেক মহিলাই ইয়েমেন যান নার্সের চাকরি নিয়ে। নিমিষা নার্সিং কোর্স করেছে এবং সেখানে সহজেই চাকরি পেতে পারে। কেরলে চাকরি না পাওয়ার কারণে, নিমিষা সোনালী স্বপ্ন নিয়ে অন্য দেশে, ইয়েমেনে চলে যায় এবং ভাল আয় করতে শুরু করে। 

কাট টু ২০১৭ সাল। খবর আসে, কেরলের বাসিন্দা নিমিষা তার ব্যবসায়িক অংশীদার তালাল আবদো মাহদিকে খুন করেছে। মাহদি হত্যার দায়ে ইয়েমেনের শরিয়ত আইনে নিমিষা প্রিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও, তার মৃত্যুদণ্ডের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, নিমিষাকে আগামী সপ্তাহে বুধবার ১৬ জুলাই ফাঁসি দেওয়া হবে।

ঠিক কী ঘটেছিল নিমিষার সঙ্গে?

নিমিষা নিজে চায়নি, কিন্তু মা বুঝেছিলেন, মেয়েকে থামিয়ে রাখা মানে তার স্বপ্নটাকেও মেরে ফেলা। তাই ১৯ বছর বয়সেই, চোখে বড় স্বপ্ন নিয়ে নিমিষা পাড়ি দিল ইয়েমেনে। প্রথম দিকে সব ঠিক ছিল। ইয়েমেনের রাজধানী সানার একটি সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেয়ে গেলে মিমিষা। মাকে ফোন করে বলল, 'মা, সব পাল্টে যাবে এবার!' মা-ও হেসেছিলেন ফোনে, বুকের ভেতর চাপা চিন্তা নিয়েই। তিন বছর কেটে যায়। নিমিষা দেশে ফিরে আসে বিয়ের জন্য। কোচির এক অটোচালক টমি থমাসের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে আবার ফিরে যায় ইয়েমেন। সংসারটা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন দু’জনে।

২০১২ সালে জন্ম হল তাঁদের মেয়ে। নতুন অতিথি যেন আলো এনে দিল জীবনে। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে ছোট শিশুকে মানুষ করা সহজ ছিল না। আর্থিক সমস্যাও মাথাচাড়া দিল। টমি ঠিকমতো চাকরিও পাচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে ২০১৪ সালে তিনি মেয়েকে নিয়ে কেরলে ফিরে এলেন। নিমিষা থেকে গেলেন ইয়েমেনে।

Advertisement

হাসপাতালেই পরিচয় হয়েছিল

এরপরই গৃহযুদ্ধের আগুন ছড়াতে থাকে ইয়েমেনে। ভারত সরকার সে দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। আর তখনই, মেয়ে আর স্বামীকে নিজের কাছে আনতে মরিয়া হয়ে উঠলেন নিমিষা। ভেবেছিলেন, নিজের একটা ক্লিনিক খুলবেন, আয় বাড়ালে পরিবারকে ফের আনতে পারবেন কাছে। কিন্তু ইয়েমেনের নিয়ম বলছে, বিদেশি কেউ ব্যবসা খুলতে চাইলে স্থানীয় কাউকে সঙ্গী করতে হয়। সেই সময় নিমিষার মনে পড়ল এক পুরনো রোগীর কথা, নাম, মাহদি। হাসপাতালেই পরিচয় হয়েছিল। ভদ্র, শান্ত স্বভাবের মানুষ মনে হয়েছিল।

নিমিষা প্রস্তাব দিলেন, 'চলুন, আমরা দু’জনে মিলে একটা ক্লিনিক খুলি।' মাহদি রাজি হয়ে গেল। এরই মাঝে মিমিষা কন্যার বাপ্তিস্মের জন্য আবার দেশে ফিরলেন। টমি ও মাহদি, দু’জনই তাঁর সঙ্গে এলেন। দেশে এক মাস থেকে তাঁরা প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ধার করেন ক্লিনিক খোলার জন্য। কিন্তু তখনই ঘটে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। মাহদি চুপিচুপি নিমিষার বিয়ের ছবি চুরি করে নেয়, পরে সে দাবি করে, 'নিমিষা আসলে আমার স্ত্রী!'

আশেপাশে কেউ নেই, আত্মীয় স্বজন হাজার মাইল দূরে

এ কথা জানতেন না নিমিষা। ফিরে গিয়ে ক্লিনিক খোলেন, নাম দেন আল আমান মেডিক্যাল ক্লিনিক। কিন্তু ধীরে ধীরে মাহদি আসল চেহারা দেখাতে শুরু করে। সে বলত, 'এই ক্লিনিক আমার স্ত্রীর।' ক্লিনিকের আয় নিজের পকেটে ঢোকাতে লাগল। গয়নাও কেড়ে নেয়। মারধর করে। এমনকি বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকিও দেয়। পাসপোর্টটাও কেড়ে নেয়, যাতে নিমিষা পালাতে না পারেন। নিমিষা পুলিশে অভিযোগ করেন। কিন্তু তাঁকেই গ্রেফতার করা হয়, ছয় দিন জেলে কাটাতে হয়। বেরিয়ে এসে দেখেন—নরক আরও গভীর। আশেপাশে কেউ নেই, আত্মীয় স্বজন হাজার মাইল দূরে।

২০১৭ সালে একদিন এক জেল কর্মচারী নিমিষাকে বলেন, 'তুমি অ্যানেস্থেশিয়া ব্যবহার করে পাসপোর্ট ফিরিয়ে নিতে পারো।' শেষ চেষ্টা করেছিলেন নিমিষা। মাহদিকে অজ্ঞান করার চেষ্টা করেন, যাতে তাঁর কাছ থেকে পাসপোর্ট উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু ওষুধের মাত্রা বেশি হয়ে যায়। মাহদি মারা যায়। অভিযোগ, নিমিষা মাহদির দেহ টুকরো করে জলের ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়। পরে পালিয়ে যা। এক মাস পর সৌদি সীমান্তে ধরা পড়েন। তারপর থেকেই শুরু হয় লড়াই।

ইয়েমেনের আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে

২০২০ সালে ইয়েমেনের আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। পরিবার আপিল করে সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু ২০২৩-এ তা খারিজ হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে হুথি বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক পরিষদ ফাঁসির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। তবু মা থেমে যাননি। তিনি পৌঁছে গিয়েছেন ইয়েমেনে, মাহদির পরিবারকে ‘রক্তের টাকা’ দিয়ে নিমিষাকে ক্ষমা করার অনুরোধ করেছেন। কয়েকবার ১৯ লক্ষ টাকা, পরে প্রায় ৩৮ লক্ষ টাকাও পাঠানো হয়েছে বলে জানায় ভারতীয় দূতাবাস।

তবু নিমিষার জীবন এখনও ঝুলে আছে। একটি চুক্তি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সময় ফুরিয়ে আসছে। আর ওদিকে, ১৩ বছরের মেয়ে প্রতি মঙ্গলবার ফোনে মাকে শুধু একটা প্রশ্ন করে, 'মা, তুমি কবে ফিরে আসবে?'

POST A COMMENT
Advertisement