সৌদি আরব, যে দেশ দীর্ঘদিন ধরে কট্টর ইসলামী অনুশাসন এবং রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল—সেখানে এখন পাল্টাচ্ছে সময়। একদিকে বিশ্বকাপ ২০৩৪-এর প্রস্তুতি, অন্যদিকে দেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়াসে সৌদি শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) নিচ্ছেন একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ইসলামিক ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটাতে তার নেওয়া পাঁচটি পদক্ষেপ সৌদি আরবকে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন দিগন্তে।
১. নারীদের গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা
২০১৮ সালে এমবিএসের সিদ্ধান্তে সৌদি নারীরা প্রথমবারের মতো গাড়ি চালানোর অনুমতি পান। এই পদক্ষেপ শুধু নারীর ক্ষমতায়নের দিকে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন নয়, বরং দেশের সামাজিক কাঠামোয়ও এক গভীর ছাপ ফেলে। আজ সৌদি আরবে কর্মশক্তির ৩৬ শতাংশই নারী। যুবরাজের ‘ভিশন ২০৩০’ ইতিমধ্যেই তার লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়েছে।
২. অমুসলিম কূটনীতিকদের জন্য মদ্যপানের অনুমতি
যদিও সাধারণ সৌদি নাগরিকদের জন্য এখনো মদ্যপান নিষিদ্ধ, তবে ২০২৪ সালে রিয়াদে প্রথমবারের মতো একটি সরকারি দোকান চালু হয়, যেখানে অমুসলিম কূটনীতিকরা মদ কিনতে পারেন। প্রায় ৭০ বছরের নিষেধাজ্ঞার ইতিহাসে এটিকে এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত মূলত চোরাচালান ও অবৈধ মদ তৈরির প্রবণতা কমাতেই নেওয়া হয়েছে।
৩. ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা হ্রাস
এক সময় সৌদির ধর্মীয় পুলিশ ‘মুতাওয়া’ সামাজিক নিয়ম-কানুন কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু যুবরাজ সালমান তাদের ক্ষমতা সীমিত করেছেন। তারা আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না, এমনকি নামাজের সময় দোকান খোলাও এখন বাধ্যতামূলক নয়। এতে দেশের সামাজিক পরিবেশ অনেক বেশি উদার হয়ে উঠেছে।
৪. বিনোদন ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব
যেখানে একসময় সিনেমা হল কিংবা কনসার্ট ছিল অকল্পনীয়, সেখানে আজ আন্তর্জাতিক তারকারা পারফর্ম করছেন রিয়াদের মঞ্চে। জেনিফার লোপেজ, হ্যালি বেরির মতো শিল্পীরা সৌদির সংস্কৃতি ও বিনোদনের দিগন্তকে বদলে দিচ্ছেন। সিনেমা হল খোলা হয়েছে, আয়োজিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিউজিক ফেস্টিভ্যাল।
৫. ভিশন ২০৩০: অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ
তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তি, পর্যটন, নবায়নযোগ্য শক্তি, রিয়েল এস্টেট—এইসব খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে সৌদি সরকার। নিওম-এর মতো মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে বিশ্বে এক প্রিমিয়াম আবাসিক কেন্দ্র গড়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে দেশটি। এমবিএসের নেতৃত্বে দেশটি নিজেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দু করে তুলতে চায়।
যেখানে এক সময় ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল সৌদি সমাজ, সেখানে আজ নারীর স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক উন্মুক্ততা এবং বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির মাধ্যমে গড়ে উঠছে এক নতুন সৌদি আরব। ইসলামী ঐতিহ্যকে ধরে রেখেই ক্রাউন প্রিন্স সালমান দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে যে বিপ্লবী পথে এগোচ্ছেন, তা বিশ্বের নজর কেড়েছে ইতিমধ্যেই।