scorecardresearch
 

আমেরিকায় ট্রাম্পের কামব্যাক, বাংলাদেশে হাসিনারও প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা? অঙ্ক যা বলছে...

রিপাবলিকান পার্টি থেকে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে নতুন রেকর্ড গড়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফেরার আশা বেড়েছে। চলতি বছরের ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসেন শেখ হাসিনা।

Advertisement
ইচ্ছা হলেই ক্ষমতায় বসায়-আবার সরায়ও, 'ট্রাম্প কার্ডেই' কেন ফেরার আশায় হাসিনা? ইচ্ছা হলেই ক্ষমতায় বসায়-আবার সরায়ও, 'ট্রাম্প কার্ডেই' কেন ফেরার আশায় হাসিনা?
হাইলাইটস
  • ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে হন
  • তখন মহম্মদ ইউনূস একে 'সূর্যগ্রহণ' এবং 'অন্ধকার দিনের' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন

চিলির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচেলেট একবার মজা করে বলেছিলেন যে আমেরিকায় কখনও অভ্যুত্থান হয়নি। কারণ সেখানে কোনও আমেরিকান দূতাবাস নেই। ২০০৯ সালে মিশেল যখন আমেরিকা সফর করেন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামাও। সাংবাদিক বৈঠকে এই কৌতুক সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মিশেল বলেন, এটি একজন আমেরিকান ব্যক্তির করা কৌতুক। এর পর মিশেল ও ওবামা দুজনেই হেসে ফেলেন। আমেরিকা সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা বিশ্বকে নিজেদের শর্তে চালাতে চায়। যে দেশে সরকার তার স্বার্থের পথে আসে, সেখানে তার পছন্দের একজন ব্যক্তিকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বসানো হয়। সামগ্রিকভাবে, আমেরিকা যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় এবং যাকে চায় তাকে বসায়। একভাবে একে 'সাম দাম দণ্ড ভেদ' নীতিও বলা যেতে পারে। এই সব বলছি কারণ এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। আমেরিকার নির্বাচনে তিনি ২৯৪ ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কোথাও কোথাও অস্থিরতা, আবার কোথাও শান্তি। বাংলাদেশও এমন একটি দেশ যেখানে অস্থিরতা রয়েছে। মহম্মদ ইউনূস বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতায়। তাঁকে 'আমেরিকাস ম্যান'ও বলা হয়। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর সেখানে অস্বস্তি বেড়েছে।

হাসিনা 'প্রধানমন্ত্রী', ইউনূসের জন্য সুর পাল্টেছে

রিপাবলিকান পার্টি থেকে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে নতুন রেকর্ড গড়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফেরার আশা বেড়েছে। চলতি বছরের ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসেন শেখ হাসিনা। তাঁকে অপসারণের পর মহম্মদ ইউনূস এখন সেখানে সরকার চালাচ্ছেন। শেখ হাসিনাও ট্রাম্পকে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা অভিনন্দন জানাতে গিয়ে নিজেকে 'প্রধানমন্ত্রী' বলেছেন। তাঁর দল আওয়ামি লিগের দেওয়া চিঠিতে লেখা হয়েছে, 'আওয়ামি লিগ সভাপতি (প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর যে বৈঠক ও কথা হয়েছিল তাও তিনি স্মরণ করেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করেছেন শেখ হাসিনা।'

Advertisement

छवि

২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে হন, তখন মহম্মদ ইউনূস একে 'সূর্যগ্রহণ' এবং 'অন্ধকার দিনের' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে 'প্রাচীর নয়, সেতু হিসেবে' কাজ করতে হবে।

তবে এখন ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হলে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইউনূস। তিনি বলেন, 'পারস্পরিক স্বার্থের অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকার বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তাঁর আগের মেয়াদে সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করতে একসঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।'

আমেরিকা কি হাসিনাকে সরিয়ে দিয়েছে?

শেখ হাসিনা, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর অভ্যুত্থানের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করেছিলেন বলে অভিযোগ। তিনি বাইডেন সরকারের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন। শেখ হাসিনা চলতি বছরের মে মাসে বলেছিলেন, 'আমি যদি কোনও বিশেষ দেশকে বাংলাদেশে বিমানঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দিই, তাহলে আমার কোনও সমস্যা হবে না।' তিনি কোনও দেশের নাম না নিলেও বলেছেন যে তিনি এই প্রস্তাব পেয়েছেন একজন 'শ্বেতাঙ্গের' কাছ থেকে। তিনি তখন বলেছিলেন যে তাঁর সরকার সবসময় সঙ্কটে থাকবে, তবে এটি নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। হাসিনা এটাও দাবি করেছিলেন যে তাঁকে ওই পূর্ব তিমুরের মতো বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি দিয়ে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অংশ নিয়ে খ্রিস্টান দেশ তৈরি করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

পূর্ব তিমুরের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা একভাবে আমেরিকার দিকে আঙুল তুলেছিলেন। পূর্ব তিমুর ২০০২ সালে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পথচলা শুরু করে। এখানে আমেরিকার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। আমেরিকা প্রতি বছর এখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদও আমেরিকার জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমেরিকা শক্তিশালী সরকার চায় না। বাংলাদেশে একটি দুর্বল সরকার চায়। তারা এমন একটি সরকার চায় যাকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারা শেখ হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।'

ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন, হাসিনার প্রত্যাবর্তন?

মহম্মদ ইউনূসকে ডেমোক্র্যাটদের ঘনিষ্ঠ মনে করা হয়। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও প্রাক্তন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যখন একটি বাংলাদেশি প্রতিনিধিদল ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তিনি ইউনূসের ওপর ক্ষুব্ধ হন। ইউনূস ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন না, তবে ট্রাম্প প্রশ্ন করেছিলেন, 'ঢাকা থেকে সেই মাইক্রো ফাইন্যান্সার কোথায়? শুনেছি তিনি চেয়েছিলেন যাতে নির্বাচনে আমরা হেরে যায়। এর জন্য তিনি চাঁদাও দিয়েছিলেন।' ট্রাম্প তখন ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের কথা বলছিলেন। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মহম্মদ ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে এক থেকে আড়াই লাখ ডলার অনুদান দিয়েছিলেন।

ট্রাম্প ও ইউনূসের সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না

আমেরিকায় রিপাবলিকান সরকার আসার বিষয়টি ইউনূসের জন্য শুভ বলে মনে করা হচ্ছে না। ২০১৭ সালে রিপাবলিকান সিনেটর চার্লস গ্রাসলি ইউনূসকে লাভবান করার জন্য ক্লিনটনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। গ্রাসলি অভিযোগ করেছিলেন যে বারাক ওবামার সরকারের সময় ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ করতে শেখ হাসিনার সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এখন ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে শেখ হাসিনার ফেরার আশাও বেড়েছে। ট্রাম্প বাংলাদেশে হিন্দু-সহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর দীপাবলি বার্তায় তিনি কমলা হ্যারিস এবং জো বাইডেনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের উপেক্ষা করার অভিযোগ করেছেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, 'আমার মেয়াদে এটি কখনই হবে না। কমলা হ্যারিস এবং জো বাইডেন আমেরিকা-সহ সারা বিশ্বের হিন্দুদের উপেক্ষা করেছেন।'

Advertisement

আমেরিকা কেন অভ্যুত্থানের জন্য অভিযুক্ত?

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লিগ নেতারা মনে করেন, বাইডেন সরকার তাঁদের উৎখাত করেছে। এখন তাঁরা আশা করছেন, ট্রাম্পের আগমনও ইউনূসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। কারণ ট্রাম্পকে পাঠানো চিঠিতে শেখ হাসিনা নিজেকে 'প্রধানমন্ত্রী' বলে উল্লেখ করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা জয়ী হন।

আমেরিকা চাইলে এটা হতে পারে

পছন্দের মুখ বসাতে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে আমেরিকার। কখনও বিরোধী দলকে সমর্থন দিয়ে আবার কখনো সন্ত্রাসবাদীী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করে সেসব দেশে বিদ্রোহ উসকে দেয়। কিছু রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশে নৈরাজ্য ছড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেক ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন। তাঁর অভ্যুত্থানে আমেরিকার হাত ছিল। আসলে মোসাদ্দেক তেল জাতীয়করণ করেছিলেন। এতে পশ্চিমা দেশগুলো ক্ষুব্ধ হয়। এরপর শুরু হয় তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর খেলা। গত বছর সিআইএ স্বীকার করেছিল যে মহম্মদ মোসাদ্দেককে অপসারণ করা ছিল অগণতান্ত্রিক। এরপর ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালা, ১৯৬০ সালে কঙ্গো, ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, ১৯৬৪ সালে ব্রাজিল এবং ১৯৭৩ সালে চিলির সরকার উৎখাতে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৭ সালে আমেরিকান লেখক স্টিফেন কিনজার তাঁর বই 'Overthrow: America's Century of Regime Change from Hawaii to Iraq' তে লিখেছেন, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা আমেরিকার বিদেশনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই বইয়ে স্টিফেন কিনজার লিখেছেন, 'আমেরিকা তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সরকারগুলোকে উৎখাত করতে মোটেও দ্বিধা করেনি।'

একইভাবে ২০১৬ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছিল যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকা ৭২টি দেশে অভ্যুত্থান চালানোর চেষ্টা করেছিল। 9/11 হামলার পর আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালায়। সেখানে ক্ষমতা থেকে তালিবানকে উৎখাত করা হয় এবং হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। হামিদ কারজাই পরে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হন। তার পরে, আশরাফ ঘানি ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে, ২০২১ সালের অগাস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর তালিবান আবার ক্ষমতায় আসে। ২০০৩ সালে, আমেরিকা ইরাকে আক্রমণ করে এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। গ্রেফতার হন সাদ্দাম হোসেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। দু বছর আগে পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকারের পতন হলে এর জন্যও আমেরিকাকে দায়ী করা হয়। গত বছরের অগাস্টে একটি ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা যায় যে আমেরিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে বলেছিল। এই ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা গেছে যে ২০২২ সালের মার্চ মাসে মার্কিন বিদেশ দফতরের দুই কর্তা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের মধ্যে কথোপকথন হয়েছিল। এই বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তারা পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার ভাল সম্পর্ক থাকবে। এর আগে ইমরান খানও অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁর সরকারের পতনে আমেরিকার হাত রয়েছে।

Advertisement