হাসিনা বেগম। বেশ কয়েকবছর ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরেই ময়মনসিংহ জেলার এই বাসিন্দা। সম্প্রতি বেশি অসুস্থ বোধ করায় বেশকিছু পরীক্ষানিরীক্ষার পর তার হার্টের দুটি ভাল্বই প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিদেশি হাসপাতালে ভর্তি, ওপেন হার্ট সার্জারি- একদিকে খরচের ভয় অন্যদিকে অস্ত্রোপচার নিয়ে অজানা আশঙ্কা। অথচ মাত্র ৫ দিনেই তার ভয় নিমিষে উড়ে গেল। সুস্থ হয়ে এখন বাড়ির ফেরার অঅপেক্ষা ৩০ বছরের হাসিনা।
গত ২৫ মে, ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউ ও হাসপাতালেই হলো তাঁর অস্ত্রোপচার। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২-৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের দুটি ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করলেন একদল তরুণ চিকিৎসক। যার নেতৃত্ব ছিলেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম।
এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপনে বাংলাদেশের এমন সফল্য স্বাস্থ্যখাতের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হাসিনা বেগমের চোখেমুখে যে স্বস্তির হাসি, তা সিয়ামসহ ১০ জন চিকিৎসকের প্রচেষ্টার ফসল। চার-পাঁচ ঘন্টার অস্ত্রোপচার। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটিয়ে জানান দিলেন উন্নত বিশ্বের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই তাঁরা।
ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম আজতক বাংলাকে বলেন, ’হার্টের ডাবল ভাল্ব অপারেশন অত্যন্ত জটিল। এমআইসিএস পদ্ধতিতে মাত্র ২-৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে ভাল্ব প্রতিস্থাপন সারাবিশ্বে অত্যন্ত বিরল। গত মঙ্গলবার (২৫ মে) আমি-সহ ১০ জন চিকিৎসকের একটি দল চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় হাসিনা বেগম (৩০) নামের এক রোগীর দেহে সফলভাবে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করি। নিজের ওপর কনফিডেন্স ছিল। আমার টিমের ওপর কনফিডেন্স ছিল, যে আমরা পারব এবং স্মুথভাবেই আমরা করেছি। কোনো সমস্যা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন ”মিনিমালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির সবচেয়ে নিরাপদ বিষয়টি হলো বুকের সব হাড় কাটতে হয় না। কাটা-ছেড়া না থাকায় পরবর্তী হাড় জোড়া লাগানোর কোনো বিষয় থাকে না। ব্যাথা অনুভব কম হয়। রক্তক্ষরণও কম হয়। অস্ত্রোপচাররের পরবর্তী সময় যত দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়, সেটার জন্য মিনিমালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির বেশ ভালো।”
এমন মাইলফলক তৈরিতে দেশের সরকার প্রধানের প্রতিও কৃতজ্ঞ চিকিৎসক দলের প্রধান। ডাক্তার সিয়াম বলেন, আমরা যে নতুন কিছু করবো বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এমআইসিএস পদ্ধতিতে হার্টের ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন- সেটা প্রধানমন্ত্রী (বাংলাদেশ) শেখ হাসিনা জানতেন। তিনি সার্বক্ষণিক নজরদারি করেছেন অস্ত্রোপচারের শুরু থেকে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত। সিয়ামের কথায় ”উনি (শেখ হাসিনা) সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে যন্ত্রপাতি কিনে দিয়েছেন। তার এই অবদানের কারণেই আমরা এমআইসিএস পদ্ধতির অস্ত্রোপচারটি সফলভাবে করতে পেরেছি। এটা সরকারের বড় সহযোগিতা। আমাদের এই সফলতা বাংলাদেশ সরকারের জন্যও গর্বের।”
ওপেন হার্ট সার্জারির পরিবর্তে মাত্র ২-৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে এমআইসিএস পদ্ধতিতে দুটি ডাবল ভাল্ব প্রতিস্থাপন হওয়ার পর মাত্র ৫ দিনে সুস্থ স্ত্রীকে দেখে আনন্দ ধরে রাখতে পারছেন না হাসিনা বেগমের স্বামীও। অস্ত্রোপচারের আগে যে ভয় ছিল - তা এভাবে উবে যাবে তা যেন ভাবনাতেও ছিলোনা তাদের। হাসিনা বেগমের স্বামী আজতক বাংলাকে বলেন, ‘অপারেশন নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম। কিন্তু এখন আর টেনশন নাই। আমার স্ত্রী সুস্থ, আমরা বাড়ি যাবো। বাংলাদেশে এমন চিকিৎসা আছে আমি তা আগে জানতাম না। নিজের দেশে এমন স্বাস্থ্যসেবা থাকতে নিশ্চয়ই কেউ আর হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপনে বিদেশে যাবে না।’
পৃথিবীজুড়ে খব স্বল্প পরিসরে যে পদ্ধতিতে হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপন হয়- সেটি বাংলাদেশের প্রথম চেষ্টায় শতভাগ সফল হওয়া চিকিৎসকদের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের। সঙ্গে আগামীর পাথেয়। স্বল্প খরচ ও মাত্র ৫ দিনেই সুস্থতায় ফেরার দৃষ্টান্ত তৈরি হওয়ায় প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশের হৃদরোগীদের এমআইসিএস পদ্ধতির জন্য বাংলাদেশমুখীও করতে পারে বলে আশা ডাক্তার সিয়ামের। তিনি বলেন, লোকে জানতো বাংলাদেশে এ ধরেণর বা হার্টের চিকিৎসা হয়না। উন্নত বিশ্বের মতো চিকিৎসা পেতে তারা ভারত কিংবা অন্যদশে যাচ্ছন। কিন্তু তারা যখন জানবেন, অবশ্যই আমাদের কাছে আসবেন। মিনিমালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারির মাধ্যমে হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপনে ভারতের চেয়ে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ খরচ কম হবে। সুতরাং এটা জানলে মানুষ আসবেন। ঠিকঠাক প্রচার হলে শুধু যে বিদেশমুখীতা কমবে তা নয়, পার্শবর্তী দেশের রাজ্য পশ্চিমবাংলাসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও মানুষ বাংলাদেশে হার্টের চিকিৎসা করাতে আসবেন। এক্ষেত্রে এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে- যা অবশ্য আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।