ইলিশ বলতেই আমাদের মনে সবার প্রথমে ভেসে ওঠে ওপার বাংলা কথা। আর বাংলাদেশে চাঁদপুরের বড় স্টেশন মাছঘাট হল সেখানকার সবচেয়ে বড় ইলিশ ল্যান্ডিং স্টেশন। এখানে পদ্মা-মেঘনা, বঙ্গোপসাগরসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব জেলার ইলিশ আসে। আর এসব ইলিশই প্যাকেটজাত হয়ে চলে যায় বিশ্বের নানা প্রান্তে।
পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল চাঁদপুর। প্রতি বছর তিন নদীর মোহনায় ধরা দেয় অসংখ্য ইলিশ। তাই এখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইলিশের বাজার।
সেই কারণে ইলিশ মাছের অন্যতম প্রজননক্ষেত্র চাঁদপুরকে ডাকা হয় ‘ইলিশের বাড়ি’ বলে। ইলিশ খেতে ও কিনতে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে এই ইলিশবাজারে মানুষের ঢল নামে।
চাঁদপুরে ভোর থেকেই ঘাটে ইলিশের পসরা বসে। চাঁদপুরের ইলিশ চেনার সহজ কিছু উপায় আছে। এখানকার ইলিশ একেবারে চকচকে রুপালি রঙের হয়ে থাকে। অন্যান্য জায়গার ইলিশের রুপালি রঙের সঙ্গে লালচে আভা দেখা যায়। ইলিশের মধ্যে চাঁদপুরের টেনুয়ালোসা ইলিশই স্বাদে, গন্ধে ও রূপে অনন্য।
অনেকের ধারণা, বড় ইলিশের স্বাদ বেশি। কিন্তু প্রকৃত স্বাদের ইলিশ ওজনে সাতশ থেকে আটশ গ্রামের হয়। এর চেয়ে বড় হলে ইলিশের স্বাদ কমে যায়। এই ইলিশকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘গাদাপুরা ইলিশ’। প্রতি কেজি দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
চাঁদপুর বাজারে ইলিশের মূল্য সারাবছর প্রায় একই থাকে। সাতশ থেকে আটশ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, এক কেজি ওজনের ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা, দেড় কেজি ওজনের ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এ ছাড়া শুধু ইলিশের ডিমও কিনতে পাওয়া যায়। প্রতি বক্স ডিম প্রায় ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
ইলিশ ছাড়াও চাঁদপুরে আছে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনা। মোহনা থেকে নৌকায় পাড়ি জমালেই পাওয়া যায় মেঘনা ও পদ্মার চর। যাওয়ার পথে নদীর বুকে জেলেদের মাছ ধরা, বিশাল জলরাশির কলকল ধ্বনি ও নদীর শীতল বাতাসের অনুভূতি মন ছুঁয়ে যাবে। বালুচরের পাশাপাশি নদীর উত্তাল ঢেউ আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে নিয়ে যাবে কক্সবাজার সৈকতে। তাই এর নাম রাখা হয়েছে মিনি কক্সবাজার। বালি চরে আছে কাশফুলের মেলা। চর থেকে ফিরে সন্ধ্যার পূর্বে নদীর বুকে লাল সূর্যের লুকিয়ে যাওয়ার মনোরম দৃশ্য বাড়িত পাওনা।
চাঁদপুর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে সমৃদ্ধ। এখানে আছে লেকের ওপর নির্মিত ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’। নদীর মোহনায় ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্য ‘রক্তধারা’। এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে ‘ইলিশ চত্বর’। জেলার বাইরে থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের তাৎক্ষণিক রূপালি ইলিশ দেখানোর জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ‘ইলিশ সেলফি স্ট্যান্ড’। এটির কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। বাংলাদেশের একমাত্র মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটও চাঁদপুরে। নদীঘেরা এই ছোট্ট শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
একদিনের ট্যুর হিসেবে চাঁদপুর খুবই চমৎকার জায়গা। একসঙ্গে নদীভ্রমণ ও ইলিশ খাওয়া হয়ে যাবে। প্রকৃতি ও সূর্যাস্তের দৃশ্য মন কাড়বেই। পারিবারিকভাবে ও বন্ধুরা মিলে ঘুরে আসতে পারেন ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে।
‘ইলিশের বাড়ি’ গেলে খেতেই হবে
ইলিশের বাজারঘেঁষে নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট হোটেল। ইলিশ মাছ কিনে আনলে সাথে ভেজে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
কোথায় থাকবেন
রাত্রিযাপন করতে চাইলে লঞ্চঘাট থেকে শহরে যেতে হবে। সেখানে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। নদীর পাড়েও কিছু হোটেল আছে, যেখানে জানালা দিয়ে নদীর দৃশ্য দেখা যাবে।
যেভাবে যেতে হবে চাঁদপুরে
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ-ভ্রমণে তিন ঘণ্টায় চাঁদপুর পৌঁছে যাওয়া যায়। নদীর শীতল হাওয়া ও চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাত্রা বেশ মনোরম। লঞ্চে এসি, নন-এসি ও কেবিন সবকিছুর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় প্রতি ঘণ্টাতেই লঞ্চ ছাড়ে। চাঁদপুর ঘাটে নামলেই আপনি হাজির ইলিশের শহরে। লঞ্চ ঘাট থেকে রিকশা বা অটোতে মাত্র ১৫ টাকায় চলে আসবেন ইলিশের বাজারে। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই তিন নদীর মোহনা। মোহনা থেকে নৌকায় মিনি কক্সবাজার। তাই করোনা লকাউন মিটলে, পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে আপিন ঘুরে আসতেই পারেন ইলিশের শহর থেকে।