বাংলাদেশের কক্সবাজারে জেলে পরিবারগুলোতে চলছে আনন্দের বন্যা। সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় চলতি সপ্তাহে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালি ইলিশ। ট্রলার ভর্তি ইলিশ নিয়ে কক্সবাজার ফিশারি ঘাটে ফিরছেন মৎস্যজীবীরা।
শুধু ইলিশ নয়, ধরা পড়ছে রূপচাঁদা, পোয়া, রিটা, থাইল্যা, ছুরি, লইট্যাসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। ব্যবসায়ী ও জেলেদের মুখে ফুটেছে হাসি। আড়তগুলোতেও ফিরে এসেছে কর্মচাঞ্চল্যতা।
বাংলাদেশ উপকূলের সাগরে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। গত কয়েকদিন ধরেই কাঙ্ক্ষিত রুপোলি ইলিশ ধরা পড়ায় হাসি ফুটেছে সাগর বেষ্টিত এলাকার জেলে, আড়তদার ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে। তবে এর প্রভাব এখনও রাজধানী ঢাকার বাজারগুলোয় এসে পড়েনি। বাজারগুলোতে ইলিশের সরবরাহ থাকলেও দাম এখনও সাধারণ মানুষের নাগালে আসেনি।
বিক্রেতারা বলছেন, বাড়তি চাহিদার কারণেই ঢাকার বাজারে দাম কমতে আরও কিছু সময় লাগবে। রাজধানীর ইলিশ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ায় উপকূলীয় বিশেষ করে কলাপাড়া, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, পাথরঘাটা এলাকার জেলেপল্লী ও আড়তগুলোতে আনন্দের জোয়ার বইছে। গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা ৬৫ দিন ইলিশ আরোহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বাংলাদেশের মৎস্য অধিদফতর। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে তারও অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ মাছ ধরার স্বাভাবিক কার্যক্রম। লম্বা বিরতির পর গত ২৩ জুলাই রাতে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় জেলেরা ট্রলার, বোট নিয়ে সাগরে গেলেও প্রথম দিকে জালে তেমন একটা ধরা পড়েনি ইলিশ। পরে অবশ্য দৃশ্যপট বদলায়। এখন প্রতিদিন জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে।
বরিশাল, পটুয়াখালী, কলাপাড়া, বরগুনা, পাথরঘাটা, ভোলার ব্যবসায়ীরা এখন ব্যস্ত । ইলিশের রাজধানী খ্যাত চাঁদপুরের বাজারও এখন বেচাকেনায় বেশ গরম। ইলিশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় নদীতে জলের প্রবাহ বেড়েছে। আর এজন্যই ইলিশ আগের চেয়ে বেশি ধরা পড়ছে। এছাড়া সামুদ্রিক নিম্নচাপ এবং সাইক্লোনের প্রভাবেও বেড়েছে ইলিশের উৎপাদন। বাংলাদেশের নদীর জলের গুণাগুণ ও প্রবাহ ইলিশের প্রজননের জন্য এখনও অনুকূলে। এ কারণে ডিমওয়ালা মা ইলিশ সাগর থেকে স্রোতযুক্ত মিঠা জলের নদীতে ডিম ছাড়তে আসে। এছাড়াও ইলিশ মাছের প্রজনন নিরাপদ রাখতে গত কয়েক বছর বাংলাদেশব্যাপী ইলিশ আহরণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ রাখছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ফলে কমেছে জাটকা, বেড়েছে ইলিশের পরিমাণ।
ইলিশ সাধারণত জুলাই মাসের শেষ দিকে সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। পদ্মা নদীর পানির স্তর ও গভীরতা অন্য নদীর চাইতে বেশি হওয়ায় ইলিশ পদ্মার দিকেই আসে। এ কারণে পদ্মা এবং এর আশপাশের সাগর এলাকায় বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালীর আড়তগুলোয় এখন শ্রমিকরা ট্রলার থেকে ইলিশ নামানোর কাজে ব্যস্ত। ঝুড়িতে করে শ্রমিকেরা ইলিশ এনে আড়তে ফেলছেন। একদিকে মাপামাপির কাজ, অন্যদিকে চলে দরদাম। পাইকারি ক্রেতারা সেসব আড়ত থেকে ইলিশ রাজধানীর বাজারগুলোয় নিয়ে আসছেন। এ কারণে যাত্রাবাড়ী, সদরঘাট, কাওরানবাজার মাছের আড়তে এখন ইলিশের ছড়াছড়ি।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাধারণত ইলিশের দাম নির্ভর করে সাইজের উপরে। এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশের দাম এবং এক কেজির কম ওজনের সাইজের ইলিশের দাম কখনোই এক হবে না। রাজধানী ঢাকার বাজারে সাড়ে তিন শ’ টাকা কেজি দরের ইলিশও পাওয়া যায়, যেখানে ২শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিতে ৫টি। আবার এক কেজি ওজনের বা তার বেশি ওজনের সাইজের ১টি ইলিশ কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে কমপক্ষে ১২শ’ টাকা। আড়তগুলোয় প্রতিকেজি ইলিশ সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে তা খুচরো বাজারে এসে সেটা ১২শ’ টাকা হচ্ছে। এছাড়া এলাকাভেদে দামও পরিবর্তন হচ্ছে।
ভোলার ইলিশ আড়তদার মোকাররম হোসেন জানিয়েছেন, ‘এবারের ধরা পড়া ইলিশের আকার বেশ বড়। তবে ছোট আকারের ইলিশও আছে। তবে তা পরিমাণে কম।’ তিনি বলেন, সামনে আরও বেশি ইলিশ ধরা পড়বে। কারণ এখনই ইলিশ ধরার প্রকৃত মৌরশুম। তাই দাম আরও কিছুটা কমবে বলেও ধারনা করছেন তিনি। বরগুনার আড়তদার সিরাজ হাওলাদার জানিয়েছেন, মাঝারি সাইজের ইলিশের চাহিদা বেশি। কারণ, মধ্যবিত্তরা এই সাইজের ইলিশই কিনতে চান। খুচরা বাজারে ৫০০ গ্রাম থেকে সাড়ে ৭শ’ গ্রাম ওজনের এক কেজি ইলিশের দাম ৬শ’ টাকা। বড় ইলিশের চাহিদা বেশি হলেও তা সবার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাই মোকামগুলোতে মাঝারি সাইজের ইলিশের চাহিদা ব্যাপক বলে জানান সিরাজ।
করোনার কারণে রফতানি অন্য বছরের তুলনায় কম হওয়ায় ইলিশের দাম আরও কিছুটা কমবে বলে জানিয়েছেন বরগুনার বেতাগির জেলে আইউব মিয়া। তিনি বলেন, অন্য বছরগুলোয় আড়তে রফতানিকারকরা আসেন বড় সাইজের ইলিশের অর্ডার দিতে। এবছর এখনও আসেননি। এখন যে ইলিশ ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত বছর সেটার দাম ছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির কান্তি বিশ্বাস জানিয়েছেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে নদী বা সাগরে মাছের প্রাপ্যতার কোনও কমতি নেই। নদীতে জলের প্রবাহ বেড়েছে বলে জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। তাই বাজারেও প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। আর আকারেও বেশ বড়। দাম এখন কিছুটা বেশি হলেও ভবিষ্যতে কমবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কার্যকর পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায় (প্রজনন মৌরশুমে মা ইলিশ রক্ষা, জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের পুনর্বাসন) বিশেষ করে নৌবাহিনী, কোস্টকার্ড, পুলিশ, প্রশাসন ও জনগণের সহযোগিতায় দেশে ব্যাপকহারে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। এবছর আশা করা হচ্ছে ৬ লাখ টনের কাছাকাছি ইলিশ উৎপাদন হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইলিশের অবদান অনেক। বাংলাদেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশ।
সব ছবি সৌজন্যে: ঢাকার ইলিশ ফেসবুক পেজ