
চার দিনের সফরে ভারতে এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। উভয়ের বৈঠকে অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের রসায়ন রয়েছে। এই সম্পর্কের ঐতিহ্য আছে, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা আছে এবং এই সম্পর্ক প্রতিবেশীর চেয়ে একটু গভীর। একই সাথে, আপনি হয়তো জানেনও না যে ভারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দ্বিতীয় বাড়ির মতো। দিল্লি হল সেই জায়গা যেখানে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আমাদের দেশে যেভাবে মানুষ মহাত্মা গান্ধীকে জাতির পিতা বলে মনে করে। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে জাতির পিতা হিসেবে দেখা হয়। শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভারত তাকে সর্বদা বঙ্গবন্ধু-বন্ধু, যার অর্থ বাংলার প্রকৃত বন্ধু হিসেবে স্মরণ করে এবং সে কারণেই শেখ হাসিনার বিমান যখন দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে, তখন সেখানে উপস্থিত তার বাবার ছবি সবার নজর কাড়ে। বিমানবন্দরে পৌঁছালে শেখ হাসিনাকেও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়।
৭টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে
দিল্লিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। যার মধ্যে মোট সাতটি চুক্তিতে হয়েছে। এতে নদী, রেল, গবেষণা, মহাকাশ এবং উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নদীর ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি নদী প্রবাহিত এবং এর জন্য উভয় দেশ যৌথ নদী কমিশন গঠন করেছে। যার এখনও পর্যন্ত ৩৮টি বৈঠক হয়েছে এবং এর মধ্যেও সর্বশেষ বৈঠকটি ১২ বছর পর গত মাসেই ২৫ অগাস্ট অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ নদীর জল বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। আর এই বিরোধের অবসান ঘটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার
শুধু ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তই নয়, উভয় দেশই একে অপরের সাথে হৃদয় দিয়ে সংযুক্ত। এই সম্পর্কটা বুঝতে পারবেন কয়েকটি বিষয় থেকে। প্রকৃতপক্ষে, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে এবং ভারতের ৫ রাজ্য অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে। এ ছাড়া উভয় দেশই ৫৪টি নদীর জল ভাগাভাগি করে এবং এই দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত জন মন গণ এবং বাংলাদেশের আমার সোনার বাংলার রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। গত পাঁচ বছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ৭২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
ভারতই প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভারতই ছিল বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা বাংলাদেশকে একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশের রূপ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধও করেছিল। মাত্র ১৩ দিনে ভারত এই যুদ্ধে জয়ী হয়। বর্তমানে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের মোট অর্থনীতির পরিমাণ ৩৩ লাখ কোটি টাকা। যেখানে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ভারতের অর্থনীতি প্রায় ২৮০ লক্ষ কোটি টাকার।
শেখ হাসিনা দীর্ঘ ৬ বছর দিল্লিতে বসবাস করছেন
শেখ হাসিনা দীর্ঘ ৬ বছর দিল্লিতে বসবাস করেছেন । ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। তখন দিল্লিতে তাঁর ঠিকানা ছিল ৫৬ রিং রোড লাজপত নগর-৩। তবে, পরে তিনি দিল্লির পান্ডারা পার্কের একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হন। লাজপত নগরে তিনি যেখানে থাকতেন সেটি এখন বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। এর আগে এই জায়গাটি বাংলাদেশ দূতাবাসকে দেওয়া হয়েছিল। যা ২০০৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। শেখ হাসিনা ২৮ বছর বয়সে ভারতে আসেন যখন তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। ঐতিহাসিক এই ঘটনার সময় শেখ হাসিনা তার স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন। কারণ তার স্বামী ছিলেন একজন পারমাণবিক পদার্থবিদ, যিনি জার্মানিতে থাকতেন। এ কারণে সেদিন হামলা থেকে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। কিন্তু তার বাবা ও পরিবারের বাকি সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
শেখ হাসিনার পরিবারকে গণহত্যা
ঘটনাটা ১৯৭৫ সালের। সে সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর কিছু সৈন্য তার বিরুদ্ধে ঢাকায় অভিযান চালায়। আর ঠিক হল সেদিনই তাকে ধরে মেরে ফেলা হবে। সে সময় ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি বাড়ি ছিল এবং তিনটি বাড়িতেই সেনাবাহিনী দখল নিয়েছিল। প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়, যার নাম আব্দুর রব সেরানিবাত, তার বাড়িতে হামলা চলে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের একজন মন্ত্রীও ছিলেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন। এরপর সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় দল শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তার ব্যক্তিগত সহকারী মো. তিনি একাধিকবার পুলিশকে ফোন করলেও কোনো সাহায্য পাননি। এ সময় সেনাবাহিনী তার বাড়িতে ঢুকে প্রথমে তার ছেলে শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করে।এর পর শেখ কামালের স্ত্রী, তার ছোট ছেলে শেখ জামাল, তার স্ত্রী এবং পরে শেখ মুজিবকেও হত্যা করা হয়।
এভাবেই হামলা থেকে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তার বোন
এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে নাসির সেনাবাহিনীর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, তিনি রাজনীতিতে নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকেও হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র রাসালের বয়স তখন মাত্র ১০ বছর, কিন্তু সেনাবাহিনী তাকেও গুলি করে হত্যা করে এবং এই সব ঘটতে থাকা অবস্থায় ফজলুল হক মনির বাড়িতে আরেকটি সেনা দল পৌঁছে যায়। যিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে। সেনাবাহিনী তাকে এবং তার পরিবারকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ফজলুল হক মনির স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। কিন্তু তাকেও সেনাবাহিনী ছাড়েনি। এভাবে সে রাতে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যা করা হয়। তবে এই হামলায় তার মেয়ে শেখ হাসিনা ও ছোট মেয়ে শেখ রেহানার প্রাণ রক্ষা পায়। কারণ তিনি তখন জার্মানিতে ছিলেন। যাইহোক, এর পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাকে দিল্লিতে আশ্রয় দেয় এবং তিনি এখানে ৬ বছর অবস্থান করেন।