
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় বাংলাদেশেও এবার ইলিশের আকাল। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে একেবারে কম। আগের মতো ইলিশ না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন জেলে থেকে শুরু করে আড়তদাররা। কম ইলিশে দামও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা শুধু বিত্তবানরাই কিনতে পারছেন। হঠাৎ করে ইলিশের এমন ‘হারিয়ে যাওয়ায়’ বিস্মিত জেলেরা! এদিকে মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশের এই ‘হারিয়ে যাওয়ার’ পেছনে কারণ মূলত আবহাওয়া।
ইলিশ ধরার ভরা মরশুম চলছে
জুলাই মাসের শেষে নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর সাগরে নৌকা ভাসিয়েছিলেন বাংলাদেশের জেলেরা। ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বঙ্গোপসাগরে এখন ইলিশ ধরার ভরা মরশুম চলছে। ইলিশের সন্ধানে সাগরে নেমেছে কক্সবাজার, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা, ভোলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক হাজার ট্রলার। নদীতে ইলিশ শিকারে থাকা একাধিক জেলে বলছেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে বিশেষ করে ইলিশের অভয়াশ্রমে জাল ফেলেও তেমন ইলিশ মিলছে না। গত বছর জালে যে পরিমাণ ইলিশ উঠেছে, এ বছর তার অর্ধেকও উঠছে না। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর প্রায় একমাস হতে চললেও এ অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা।
কী করাণে উঠছে না ইলিশ?
তবে কী কারণে জালে ইলিশ উঠছে না তার তেমন কোনও ব্যাখ্যা জানা নেই জেলেদের কাছে। আড়তগুলোর ইলিশ সংকটে হাহাকার করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়ীদের হতাশা। কারণ, সারা বছর ইলিশ পাওয়া যায় না। যে সময় ইলিশ পাওয়ার কথা সে সময় যদি না পাওয়া যায় তাহলে ব্যবসায়িক ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয়।
বরিশাল থেকেই আসে ইলিশের যোগান
বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইলিশের যোগান আসে বরিশাল বিভাগের নদ-নদী ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর থেকে। এবার ভরা মরশুমেও এ অঞ্চলে ইলিশের আনাগোনা কম। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাধা পেয়ে ইলিশ গতিপথ পাল্টেছে। নদ-নদীতে ইলিশ কম আসার কারণ সম্পর্কে জেলেরা বলছেন, নদীতে ইলিশের প্রবেশপথে ও সাগর মোহনায় অসাধু জেলেরা বেহুন্দি, চরগড়া, খুঁটাজাল, ভাসা জালের মতো ছোট ফাঁসের অবৈধ জাল পেতে ঘিরে রাখছেন। এসব জাল অনেকটা বেড়ার মতো। এসব জালে বাধা পেয়ে ইলিশ আবার সাগরে ফিরে যায়। অবৈধ এ জাল যেখানে পাতা হয়, সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই চর পড়ে যায়। ডুবোচর সাগর থেকে নদীতে প্রবেশের মুখে বাধা, অবৈধ জাল আর উত্তরের ঢালে পলি–বর্জ্য থাকায় ইলিশ এবার গতিপথ পরিবর্তন করেছে বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
সামনের পূর্ণিমায় কি আসছে 'আচ্ছে দিন'?
বরিশালের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই সময়ে ইলিশ মাছে বাজার সয়লাব থাকার কথা। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আর এ জন্য দামও নাগালের বাইরে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য বন্দর পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এই মরসুমে যেখানে তিন–চার হাজার মণ ইলিশ আসার কথা, সেখানে লক্ষ্যমাত্রার থেকে ইলিশ আসার পরিমাণ অনেক কম। দামও চড়া। মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্ষার মরশুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ইলিশের আধিক্য দেখা যায়। ইলিশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জলের স্ফীতি ও স্রোত বাড়লে এ মাছ আন্দোলিত হয়। এ সময় তারা দল বেঁধে উপকূলের মিষ্টিজলে ফিরে আসে। আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ প্রকল্প-২–এর দলনেতা মাৎস্যবিজ্ঞানী আবদুল ওহাবের মতে, ‘ইলিশ গতিপথ পরিবর্তন করলেও এটা সাময়িক। এই সাময়িক পথ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন বৃষ্টিপাতের তারতম্য, নদীতে ফেরার পথে বাধা, চর-ডুবোচরে নাব্যতাসংকট, দূষণের মতো সমস্যাগুলো প্রকট হচ্ছে। সাময়িক গতিপথ বাঁক নেওয়ার বিষয়গুলো আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’ তবে এ মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ উপকূলে ইলিশের প্রাচুর্য বাড়বে বলে তিনিও আশাবাদী। তবে এর মধ্যে আশার খবর কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করেছে। তাই চলতি অগাস্টের শেষ দিকে ইলিশের খরা কাটবে বলে আশাবাদী মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে হবে পূর্ণিমা। সে সময় জালে প্রচুর ইলিশ উঠবে বলেই আশাবাদী বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। প্রতিবছর পুজোরা আগি হাসিনা সরকার পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে উপহার হিসাবে ইলিশ পাঠিয়ে থাকেন। গত দু'বছর সেপ্টেম্বরে সেই ধারাই দেখা গেছে। তবে এবার এনিয়ে এখনও মুখ খোলেনি বাংলাদেশ প্রশাসন। অবশ্য বাংলাদেশে এবার এখনও তেমন ইলিশ জালেও ওঠেনি। অগাস্টের শেষে যদি সত্যিই খরা কাটে তাহলে কে বলতে পারে এপার বাংলার ভোজন রসিকদের জন্য ওপার বাংলা থেকে ইলিশের আগমনের সুখবর আসতে পারে।