বাবাকে ভীষণ ভয় পেতেন। মূলত তাঁর মারের ভয়েই মহম্মদ ইউসুফ খান (Mohammed Yusuf Khan) থেকে হয়ে গেলেন দিলীপ কুমার (Dilip Kumar)। সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) মতে তিনি ছিলেন, 'দ্য আল্টিমেট মেথড অ্যাক্টর।' প্রায় ছয় দশক ধরে ৬৩টি ছবিতে অসামান্য অবদান রেখে গেলেন দিলীপ কুমার। একই সঙ্গে আপামর ভারতবাসীর মনেও অমরত্ব পেলেন।
১৯২২ সালে কনকনে ঠাণ্ডায় পাকিস্তানের পেশোয়ারে জন্ম ইউসুফের। লালা গুলাম সারওয়ার খান এবং আয়েশা বেগমের দ্বাদশ সন্তান। সারওয়ার খান ছিলেন ফ্রুট মার্চেন্ট। পেশোয়ার থেকে খুব অল্প বয়সে পরিবারের সঙ্গে নাসিকের কাছে দেওলালিতে চলে আসেন তিনি। সেখানেই পড়াশোনা। পারিবারিক বন্ধু ছিলেন রাজ কাপুর (Raj Kapoor)। তবে বাবা সারওয়ারের চূড়ান্ত অপছন্দ ছিল সিনেমা। ফলে ইচ্ছে থাকলেও সিনেমায় অভিনয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারেননি দিলীপ।
১৯৪০-এর দশকে হঠাৎ করেই স্বপ্নপূরণের সুযোগ আসে তাঁর কাছে। দেখা হয় বম্বে টকিজের (Bombay Talkies) মালকিন দেবীকা রানির (Devika Rani) সঙ্গে। যাঁকে ভারতীয় সিনেমার ফার্স্ট লেডি (The First Lady of Indian Cinema) বলা হয়। তিনি দিলীপকে তাঁর পরের প্রোডাকশন জোয়ার-ভাটার জন্য নায়ক হিসাবে মনোনীত করেন। সিনেমার টাইটেল কার্ডে কী নাম যাবে তা নিয়ে দিলীপের কাছে তিনটি বিকল্প রাখা হয়। প্রথমটি ছিল তাঁর নিজের নাম। পরেরটি ছিল দিলীপ কুমার। শেষ ছিল বাসুদেব। একটি সাক্ষাৎকারে দিলীপ জানিয়েছিলেন, সে সময় তিনি ইউসুফ খান বাদ দিয়ে যা খুশি নাম রাখার কথা বলেছিলেন। যাতে তাঁর বাবা কোনও ভাবে সিনেমায় অভিনয়ের কথা জানতে না পারেন। ১৯৪৪ সালে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর তিনি দেখেন টাইটেল কার্ডে নাম গিয়েছে দিলীপ কুমার। এই নামটিই বেছে দিয়েছিলেন দেবীকা রানি।
তিন বছর পর অভিনেত্রী নূর জাহানের (Noor Jehan) সঙ্গে জুগনু তাঁকে পরিচিত দেয়। ১৯৪৯ সালে রাজ কাপুর, নার্গিসের (Nargis) সঙ্গে অভিনীত অন্দাজ ছবি তাঁকে দেয় প্রতিষ্ঠা। তার পর থেকে ভারতীয় সিনেমায় শুরু হয় দিলীপ কুমারের নতুন যুগ। দিলীপ কুমার অভিনীত মুঘল-এ-আজম ভারতীয় সিনেমার সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা হিসাবে গণ্য হয়। তা ছাড়াও অসংখ্য হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। ছিলেন রাজ্য সভার সদস্য। একমাত্র ভারতীয় হিসাবে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সম্মান নিশান-এ-ইমতিয়াজ (Nishan-e-Imtiaz) সম্মান পেয়েছেন তিনি। পেয়েছে পদ্মভূষণ (Padma Bhushan) এবং দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্ম বিভূষণ পুরস্কার (Padma Vibhushan)। ভারতীয় সিনেমায় অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন দাদা সাহেব ফালকেও (Dadasaheb Phalke Award)। অনেকেই জানেন না লরেন্স অফ আরবিয়া (Lawrence of Arabia) সিনেমায় শেরিফ আলির চরিত্রের জন্য দিলীপ কুমারকে চূড়ান্ত করেছিলেন পরিচালক ডেভিড লিন (David Lean)। কিন্তু দিলীপ রাজি না হওয়ায় সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত ইজিপশিয়ান অভিনেতা ওমর শরিফ (Omar Sharif)। পরে তাজমহল নিয়ে আরও একটি ছবি তৈরির ভাবনা ছিল ডেভিডের। সেখানে তৎকালীন অন্যতম সেরা হলিউড অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের (Elizabeth Taylor) বিপরীতে কাস্ট করার কথা ছিল দিলীপ কুমারের। কিন্তু সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
জীবনে বহুবার প্রেমে পড়েছেন দিলীপ। অভিনেত্রী কামিনী কৌশলের (Kamini Kaushal) সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। পরে সে যুগের অন্যতম সেরা সুন্দরী অভিনেত্রী মধুবালার (Madhubala) সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। ৭ বছর চলেছিল তাঁদের সম্পর্ক। মধুবালাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন দিলীপ। কিন্তু মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খানের প্রবল আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। বি আর চোপড়া-র (B R Chopra) নয়া দৌড় সিনেমা নিয়ে মামলায় মধুবালার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেন দিলীপ। সে দিনের পর ভেঙে যায় ৭ বছরের পুরনো সম্পর্ক। এর পর অভিনেত্রী বৈজন্তীমালার (Vyjayanthimala) সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন দিলীপ। একটি সাময় এমন ছিল, শুটিংয়ের সেটে দিলীপ যে পোশাক ঠিক করে দিতেন, সেটাই পরতেন বৈজন্তীমালা। তবে সে সম্পর্কও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তৎকালীন হাইয়েস্ট পেইড অভিনেত্রী সায়রা বানু-কে (Saira Banu) ১৯৬৬ সালে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার। দিলীপের বয়স তখন ৪৪। সায়রা ছিলেন ২২! ১৯৮১ সালে আসমা সাহিবাকে বিয়ে করেন। যদিও সেই বিয়ে টিকেছিল মাত্রে দুবছর, ১৯৮৩ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
নিঃসন্তান দিলীপ এবং সায়রার জীবনে ১৯৭২ সালে একবার বাবা-মা হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সায়রার শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ঈশ্বরের ইচ্ছে মনে করে তার পর থেকে নিঃসন্তান জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন দুজনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্ত্রী সায়রা দিলীপের হাত ছাড়েননি। ৭ জুলাই সেই হাত ছাড়িয়ে নিজেই চলে গেলেন দিলীপ। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভারতীয় সিনেমার একটা সোনালি যুগও।