সংখ্যার বিচারে হোক, বা গায়কির বিচারে, এ মুহূর্তে দেশের সমস্ত শ্রোতাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁদের প্রিয় গায়ক কে? অধিকাংশের মুখে একটাই নাম উঠে আসবে, অরিজিৎ সিং। সঙ্গত কারণেই। ব্লুজ হোক বা বসন্ত-বাহার, আদ্যোপান্ত পার্টির গান হোক বা ফির লে আয়া দিল-আয়াত, সব গানকে নিজের করে শ্রোতাদের কানে মধু ঢেলেছেন অরিজিৎ। গায়ক হিসাবে প্রায় সমস্ত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন। এ বার সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করছেন অরিজিৎ। আগামী ২৬ মার্চ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাচ্ছে সানিয়া মালহোত্রা-র ছবি পাগলাইট, সেই ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অরিজিৎ।
স্পটিফাই অ্যাপে এর মধ্যেই গানগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। সঙ্গীত পরিচালকদের যদি শিক্ষক ধরা হয়, তবে সব ছাত্রের যেমন প্রিয় কয়েকজন শিক্ষক থাকেন। অরিজিতেরও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যে নাম উঠে আসে তিনি হলেন এ আর রহমান। দ্বিতীয়জন অবশ্যই প্রীতম। এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনা না বললেই নয়। অনুরাগ বসু-র বরফি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন প্রীতম। গোটা অ্যালবামটি সুপারহিট। তবে সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ফির লে আয়া দিল তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। সেই গানটি প্রথমে পাকিস্তানি গায়ক শফকত আমানত আলি-র গাওয়ার কথা ছিল। সময় মতো তিনি এসে গানটি রেকর্ডও করে যান। অরিজিৎ তখন নিয়মিত সঙ্গীত পরিচালকদের মিউজিক অ্যারেঞ্জ করতে সাহায্য করেন। অমিতাভ ভট্টাচার্যের লেখা গানটি শুনে প্রীতমেরই একটু অন্যরকম সুরে হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতে শুরু করেন অরিজিৎ। তখনও কেউ জানতেন না যে এমন একটি গান সৃষ্টি হতে চলেছে। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো গানটি শুনে গিয়েছেন। শফকতের গান থাকলেও ছবিতে অরিজিতের করা ভার্শানটি ব্যবহৃত হয়। বাকিটা ইতিহাস।
এমনিতে তিনি সাক্ষাৎকার দিতে পছন্দ করেন না। সবচেয়ে বড় কথা সময়ও পান না। তবে যে কটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাতে অরিজিৎ নিজেও একাধিকবার জানিয়েছেন, তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে চর্চা করতে চেয়েছেন বরাবর। গজল গায়ক হতে চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতে সঙ্গীত পরিচালক হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। সে ইচ্ছের শুরুটা হয়েই গেল। তাঁর স্বরই শুধু শ্রোতাদের মন ভরাবে না, সঙ্গে সুরও মন ভরাবে। সিনেমায় গান গেয়েছেন নীতি মোহন, হিমানি কাপুর, অন্তরা মিত্র, চিন্ময়ী শ্রীপদ, সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘনা মিশ্র, অমৃতা সিং। ছবিতে রফতার এবং রাজা কুমারির র্যাপও শোনা যাবে। অমৃতা অরিজিতের বোন। এর আগে জেনারেশন আমি ছবিতে গান গেয়েছেন। বাকিরাও যথেষ্ট ভালো কাজ করছেন। এখানে একটা বিষয় না বললেই নয়, অরিজিৎ কিন্তু নতুনদের উপর ভরসা রেখেছেন বেশি। অনেকে বলবেন, এঁরা বেশ কয়েক বছর ধরে চুটিয়ে বলিউডে কাজ করছেন। ঠিক কথা, তবে এঁদের গান অনেক ক্ষেত্রেই ছবিতে জায়গা পায়নি। হয়তো নিজের কেরিয়ারের কথা ভেবেই নতুন প্রতিভাদের তুলে ধরার প্রয়াস অরিজিতের।
এ বার আশা যাক উপসংহারে। একে উপসংহার না বলে ভূমিকাও বলা যেতে পারে। দিন কতক আগে অরিজিৎ নিজের সোশাল দেয়ালে একটি ভিডিও পোস্ট করে সঙ্গীত পরিচালনা সম্পর্কে অনুরাগীদের জানান। সেখানে একেবারে শুরুর স্তবকেই একজনের নাম জ্বলজ্বল করছে। তিনি এ আর রহমান। অরিজিৎ লেখেন, 'পাগলাইট ছবির মিউজিক কম্পোজ করে আমি গর্বিত। আমি এই অ্যালবাম এ আর রহমানকে ডেডিকেট করছি। তিনি আমার সঙ্গীত সফরের অন্যতম গাইড। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং সাউন্ডস্কেপ নিয়ে তাঁর অসম্ভব প্যাশন আমায় অনুপ্রাণিত করেছে। গানের ফাঁক, সোম এবং রাগের বোধ হওয়ার সময় থেকে তিনি আমায় অনুপ্রাণিত করে আসছেন।'
রহমান অরিজিৎকে ঠিক কতটা অনুপ্রাণিত করেছেন তা অ্যালবাম শুনলেই বুঝতে পারবেন। তবে এটাও ঠিক, তিনি রহমানকে নকল করেননি। যাঁরা সঙ্গীতে কখনও না কখনও নাড়া বেঁধেছেন তাঁরা জানেন, ঘরানা তৈরি করা খুব কঠিন। স্বকীয়তা, নিজস্বতা একদিনে তৈরি হয় না। রহমান, শঙ্কর-এহসান-লয়, অমিত ত্রিবেদী, প্রীতম এঁদের তো নিজস্ব একটা ঘরানা তৈরি হয়েই গিয়েছে। নতুনদের মধ্যে তানিষ্ক বাগচী, অর্কপ্রভ যথেষ্ট ভালো কাজ করছেন। অরিজিৎ সিং নিজের আলাদা ঘরানা তৈরির দাবি জানিয়ে রাখলেন ছবিতে। এমন ঘরানা, যার গান শুনলে বুঝবেন এতে অরিজিতের ছোঁয়া রয়েছে।