সঙ্গীত জগতের নক্ষত্র বললেও বোধ হয় কম বলা হবে। উস্তাদ জাকির হুসেনকে চেনেন না বা তাঁর নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুবই কম। প্রয়াত তবলার সেই যাদুকর জাকির হুসেন। আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোর এক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। চিকিত্সা চলছিল আইসিইউতে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ৭৩ বছরেই থেমে গেল জীবনের পথচলা। ভারতীয় সময় আজ সোমবার সকালে তাঁর প্রয়াণের খবর নিশ্চিত করল শিল্পীর পরিবার।
গত কয়েকদিন আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। গতকাল রবিবার আচমকাই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক বলেই জানা গিয়েছিল। আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন শিল্পী। রক্তচাপ জনিত সমস্যার ফলে হার্টের সমস্যাও ধরা পড়েছিল কিংবদন্তি তবলা বাদকের। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। শিল্পী প্রয়াত হলেও । কিংবদন্তি তবলাবাদকের কাজ হৃদয়ে থেকে যাবে দেশ ও বিদেশের অগুণতি মানুষের। জাকির হুসেন রেখে গেলেন স্ত্রী অ্যান্টোনিয়া মিনেকোলা, তার মেয়ে আনিসা কুরেশি ও ইসাবেলা কুরেশি, দুই ভাই তৌফিক এবং ফজল কুরেশি এবং বোন খুরশিদ আউলিয়াকে।
১৯৫১ সালের ৯ মার্চ মুম্বইয়ের মাহিমে তবলা বাদক আল্লা রাখা এবং ববি বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন জাকির হুসেন। খুব অল্প বয়সেই তবলা বাজানোর প্রতি ঝোঁক দেখা যায় শিল্পীর। জাকির হুসেন মাত্র ৩ বছর বয়সে তাঁর বাবার কাছ থেকে মৃদং (একটি শাস্ত্রীয় তালবাদ্য বাদ্যযন্ত্র) বাজানো শিখেছিলেন এবং ১২ বছর বয়সে কনসার্টে পারফর্ম করতে শুরু করেন। অসাধারণ প্রতিভার কারণে পদ্মভূষণ এবং পদ্মশ্রী এবং সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। জাকির হুসেন এই বছর ৩টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। মুম্বইয়ে ওস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি।
পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত জাকির হোসেন, পেয়েছিলেন তিনটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। ২০২৪ সালে তাঁর হাত ধরেই দেশে আসে গ্র্যামি পুরস্কার। ‘বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম’ হিসাবে পুরস্কৃত হয় ভারতীয় ব্যান্ড ‘শক্তি’র গানের অ্যালবাম ‘দিস মোমেন্ট’। ‘শক্তি’ ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী শঙ্কর মহাদেবন। তবলা বাদক হিসাবে ছিলেন জাকির। কিংবদন্তির প্রয়াণে শোকস্তদ্ধ সঙ্গীত জগত থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও অভিনয় দুনিয়াও। জাকির হুসেনের সুর, তাল এবং বাদন নিয়ে তাঁর অসামান্য দক্ষতা এবং সৃষ্টিশীলতা তাকে পৃথিবীজুড়ে শ্রদ্ধার পাত্র করে তোলে। পশ্চিমী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত, জ্যাজ এবং বিশ্ব সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি অসংখ্য শিল্পীর সঙ্গে সফলভাবে সহযোগিতা করেছেন, যার মধ্যে জর্জ হ্যারিসন, জন মাকলফলিন এবং রবি শঙ্করের মতো বিশিষ্ট শিল্পী রয়েছেন। তাঁর ‘শক্তি’ নামক যৌথ প্রজেক্ট সংগীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
তার প্রথম অ্যালবাম লিভিং ইন দ্য ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এর পরে, ১৯৭৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত, জাকির হুসেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসব এবং অ্যালবামে তার তবলার জাদু প্রদর্শন করেন। তবে কেরিয়ারে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত ছিল ১৯৭৩ সালে গিটারিস্ট জন ম্যাকলাফলিন, ভায়োলিন বাদক এল শঙ্কর ও ঘটম বাদক টিএইচ ভিক্কুর সঙ্গে যুগলবন্দী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জ্যাজের মেলবন্ধন ছিল, যা ওই যুগে কেউ কল্পনাই করতে পারত না।
জানা যায়, প্রথম দিকে তবলাবাদক উস্তাদ জাকির হুসেনের অর্থের অভাব ছিল। সে সময় তিনি ট্রেনের সাধারণ বগিতে যাতায়াত করতেন। ট্রেনে সিট না পেলে মেঝেতে খবরের কাগজ বিছিয়ে ঘুমোতেন। জাকির হুসেন তার শিল্প ও তবলাকেই সবকিছু মনে করতেন। তবলা কোলে নিয়ে ঘুমোতেন যাতে কেউ তাতে পা না দেয়। কলকাতার সঙ্গেও ছিল তাঁর নিবিড় টান। ডোভার লেন সংগীত সম্মেলনে একাধিকবার এসেছিলেন তিনি। পণ্ডিক অজয় চক্রবর্তী এবং পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের সঙ্গেও তাঁর যুগলবন্দি দেখেছে তিলোত্তমা। চলতি ডিসেম্বরেই কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে দেখা যায় জাকিন হুসেনকে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই চিরদিনের মতো থেমে গেল কিংবদন্তী মায়েস্ত্রোর হাতের জাদু।
জাকির হুসেনের প্রয়ানে অমিতাভ বচ্চন থেকে কমল হাসান, করিনা কাপুর, রণবীর সিং-সহ বলিউডের একাধিক তারকা শোকপ্রকাশ করেছেন। উস্তাদের মৃত্যুতে শোকের ছায়া সব মহলেই। এদিন জাকির হুসেনের মৃত্যুর খবর পেয়ে এক্স হ্যান্ডেলে শোকপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, ‘উস্তাদ এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তবলা বাদক জাকির হুসেনের অকাল মৃত্যুতে মর্মাহত। দেশ এবং বিশ্ব জুড়ে তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তদের জন্য একটি বিশাল ক্ষতি। শিল্পীর পরিবার এবং অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’