তাঁকে নিয়ে মানুষের কৌতুহল আজও একই রয়ে গিয়েছে। রূপোলি পর্দায় তাঁর উপস্থিতি লাখো পুরুষ হৃদয়ে ঝড় তুলত। তাঁর চাহনি থেকে হাসি সবেতেই ফিদা ছিলেন বাঙালি পুরুষরা। আট থেকে আশি আজও যাঁকে সবাই মনে রেখেছেন, যাঁর স্মৃতি কোনওদিন অমলিন হবে না, তিনি হলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen)। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সেই মিসেস সেন দীর্ঘ ৩৬ বছর নিজেকে নিয়ে চলে যান নিভৃতবাসে। সেটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। সুচিত্রা সেনের অন্তরালে থাকার একাধিক কারণ সামনে আসলেও এই একটি কারণের জন্যই তিনি আমৃত্যু পর্যন্ত নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন। এমনকী তাঁর মৃত্যুর সময়ও মহানায়িকার মুখ কেউ দেখতে পারেননি। সেটাও ছিল মিসেস সেনেরই ইচ্ছা।
সুচিত্রা সেনকে নিয়ে রয়েছে বহু মিথ
অনেকেই বলেন যে মহানায়ক উত্তম কুমারের মৃত্যুর পরই নাকি সুচিত্রা সেন নিজেকে অন্তরালে নিয়ে চলে যান। এ কথা বাংলা ফিল্ম জগতের সকলেই জানেন যে সুচিত্রা সেন কতটা ভালোবাসতেন উত্তম কুমারকে। কিন্তু সেই তথ্য ঠিক নয়। প্রসঙ্গত, তাঁকে নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ, প্রশংসা সবই হয়েছে ভুরি ভুরি। তবে তিনি মানুষের হৃদয়ে রয়ে গিয়েছেন চিরন্তন সুন্দরী হিসেবেই। তার থেকেও বড় কথা ভারতীয় সিনেমার এই কিংবদন্তী নায়িকাকে নিয়ে মিথের তো শেষ নেই। সুচিত্র সেনের বন্দি জীবন যাপন তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন মিথকেই বার বার উস্কে দিয়েছে।
রমা থেকে মহানায়িকা হওয়ার কাহিনি
সুচিত্রা সেন জানতেন কখন কোথায় কীভাবে নিজেকে পরিবেশন করতে হবে। সাফল্য বা অর্থ কোনওটার পিছনেই তিনি দৌড়াননি, সবই ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে নিজে থেকেই। ভালো ছবি ও চিত্রনাট্য মহানায়িকাকে বারংবার আকর্ষণ করত। সেই টানেই তিনি ছুটে যেতেন। আর তৈরি হত একের পর এক হিট ছবি। আসলে বলা চলে তাঁর সিনেমার প্রতি এই ভালোবাসার কারণেই স্টারডম ও সাফল্য তাঁকে খুঁজে নিয়েছিল। এতদিন যাবৎ যে সব অভিনেত্রাদের ইন্ডাস্ট্রি পেয়েছে, তাঁরা সাধারণত লাইমলাইটে থাকতেই ভালোবাসেন। কিন্তু সুচিত্রা সেন ব্যতিক্রম। কেরিয়ারের মধ্য গগনে এসে তিনি নিজেকে আচমকাই অন্তরালে নিয়ে চলে যান। যেই নিভৃতবাস চলেছিল তাঁর মৃত্য পর্যন্ত। পাবনার রমা দাশগুপ্ত কলকাতা শহরে এসেছিলেন তিনি রমা হয়ে। কিন্তু তাঁর প্রতিভা তাঁকে বানিয়েছে মিসেস সেন। আজও মহানায়িকা বলতে বাঙালি চেনেন একজনকেই তিনি হলেন সুচিত্রা সেন
পেয়েছিলেন সেরা স্বীকৃতি
কেরিয়ার শুরুর ১০ বছরের মাথায় এল জীবনের অন্যতম সেরা স্বীকৃতি। সপ্তপদী ছবির জন্য পেলেন প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার। Moscow International Film Festival-এ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন তিনি। সুচিত্রা সেনই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি এই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। বরাবরই জেদি, দৃঢ়চেতা স্বভাবের অধিকারিণী ছিলেন সুচিত্রা সেন। নিজের কেরিয়ারে মধ্যগগণে থেকেই সব কিছুর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন সালটা ছিল ১৯৭৮। বছরের পর বছর ধরে তিনি ছিলেন অন্তরালে। তারপরই রামকৃষ্ণ আশ্রমে দীক্ষিত হন তিনি। শেষবার মহানায়িকাকে দেখা গিয়েছিল ভোট দিতে তারপর আর কখনও জনসকমক্ষে আসেননি তিনি।
আরও পড়ুন: প্রাক্তনের প্রবেশ? শোভন-স্বস্তিকার রিলেশনে ফাটল
উত্তম-সুচিত্রা জুটি
উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অনস্ক্রিন একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। তাঁদের জুটি এতটাই বিখ্যাত ছিল, এখনও অবধি মানুষ প্রেমিক ও প্রেমিকার জুটির উপমা হিসাবে বেছে নেন উত্তম ও সুচিত্রাকে। সুচিত্রা ছাড়াও উত্তম বহু নায়িকার সাথে অভিনয় করলেও সুচিত্রার আগমন তাঁকে সম্পূর্ণ করত। অপরদিকে সুচিত্রা , অন্যান্য নায়কের সাথে হিন্দি ও বাংলা ফিল্মে অভিনয় করলেও উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর জুটি বাঙালিকে মুগ্ধ করত। কিন্তু বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আকাশে হঠাৎই ঘটিয়ে এল কালো মেঘ। মহানায়ক উত্তম কুমারের অকালপ্রয়াণ ঘটল। ভেঙে গেল বাঙালির চিরকালীন উত্তম-সুচিত্রা জুটি। রয়ে গেল একরাশ নস্টালজিয়া। কিন্তু সুচিত্রা ছিলেন পেশাদার অভিনেত্রী। অথচ তাঁর পেশাদারিত্ব পেল না মর্যাদা।
সঠিক মর্যাদা দেয়নি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি
প্রযোজক ও পরিচালকদের একাংশের মনে হল, সুচিত্রা একা মূল্যহীন। অথচ এই নায়িকা তৎকালীন মুম্বইয়ের বুকে রীতিমত তারকা হয়ে উঠেছিলেন। তবুও কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। তথাকথিত সুচিত্রানুরাগীদের মনে হল, উত্তম ছাড়া সুচিত্রা গ্রহণযোগ্য নন। পরমাসুন্দরী সুচিত্রার বয়স ও তাঁর চেহারা নিয়ে কটাক্ষ হল ‘ফরিয়াদ’ ফিল্মের মুক্তির পর। ‘ফরিয়াদ’-এ সুচিত্রার চরিত্রটি ছিল এক মায়ের, যিনি সন্তানকে মানুষ করতে, তাকে পড়াশোনা করাতে অবলীলায় রাতের পর রাত বারে গান গাইতেন। সেই সময় চরিত্রের প্রয়োজনে সুচিত্রা বিশেষ কিছু পোশাক পরলেও, সেগুলি তেমন খোলামেলা ছিল না। কিন্তু মেয়েদের ‘কুড়িতে বুড়ি’ মনে করা সমাজ সুচিত্রার সেরা অভিনয়কে অনুভব করল না। তাঁকে বয়স ও চেহারা নিয়ে অপমানিত করল। মুখ বুজে কিছুদিন সহ্য করেছিলেন সুচিত্রা। ভেবেছিলেন, মানুষ হয়তো ভুল বুঝবে। কিন্তু তিনি জানতেন না, এক নারীকে সঠিক মর্যাদা দিতে শেখেনি সমাজ।
আরও পড়ুন: বিয়ে হওয়ার কথা চলছিল, সৃজিত-ঋতাভরীর রিলেশনটা ভেঙেছিল কেন?
কেন গেলেন নিভৃতবাসে
১৯৭৮ সালে সুচিত্রা সেন ‘প্রণয় পাশা’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেন। এটিও ছিল তাঁর শেষ সিনেমা। যেটি ফ্লপ হয়। এতে তিনি দারুণভাবে ভেঙে পড়েন, কষ্ট তারপর দীক্ষা নেন রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় পবিত্র ধর্মগুরু ভারত মহারাজের। মহানায়িকা নাকি মহারাজের পায়ের কাছে বসে অনেক কেঁদেছিলেন। সুচিত্রা সেনকে নিয়ে লেখালেখি করা সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায়ের বইতে মিলেছিল এই তথ্য। সেখান থেকেই জানা যায় যে ভারত মহারাজ মহানায়িকাকে বলেন, “মা অর্থলিপ্সু, লোভী হও না।” ভারত মহারাজের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ সুচিত্রাকে স্বেচ্ছাবন্দী হওয়ার পথে নিয়ে যায়। তারপর স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান মহানায়িকা। তাই বলে এই নয় যে তিনি প্রকাশ্যে একদমই বেরোতেন না। তিনি তার দুই নাতনি রিয়া এবং রাইমাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার ভিক্টোরিয়াতে ঘুরতে যেতেন। কিন্তু কালের নিয়মে বয়সের ছাপ পড়েছিল তার চেহারায়। আর তাতেই নাকি বাঙালি চিনতে পারত না তাদের মহানায়িকাকে।
মৃত্যুর পরও তাঁকে আনা হয়নি সকলের সামনে
মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে আনা হয়নি তাঁকে এমনটাই ইচ্ছে ছিল সুচিত্রা সেন। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেসরকারি নার্সিংহোম বেলভিউ-এর বুকে ভেঙে পড়েছিল ভিড়। সে ছিল এক মহাযাত্রা। পিছনে ছেড়ে যাওয়া এক সংসার। সদ্য প্রয়াতা মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে একঝলক দেখতে চেয়েছিলেন কলকাতাবাসী। অধিকাংশ মানুষ ভেবেছিলেন, এতদিনের সযত্নে তৈরি অন্তরাল এবার হয়তো ভেঙে যাবে। শেষবারের মতো সকলে দেখতে পাবেন মহানায়িকার মুখশ্রী। কিন্তু তিনি সুচিত্রা সেন, মৃত্যুতেও ভাঙলেন না আড়াল। সাদা বেনারসি পরিহিত, মাথায় ঘোমটা সুচিত্রা নিজেকে আড়ালে রেখেই যাত্রা করলেন মহাসিন্ধুর ওপারে।