২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল 'সহজ পাঠের গপ্পো'। ছবিতে না আছে বড় তারকাদের সমাহার, না ছিল প্রচারের চাকচিক্য। এই ছবির মাধ্যমেই পরিচালনায় হাতেখড়ি হয় মানস মুকুল পালের। প্রথম ছবিতেই ছক্কা হাঁকান তিনি। চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছে দারুণ প্রশংসা পায় এই ছবি। গত তিন দশকের মধ্যে এটিই একমাত্র বাংলা ছবি যা, সেরা শিশু অভিনেতা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১০ বছর। দর্শকেরা অপেক্ষায় ছিলেন, কবে আসবে মানস মুকুলের পরের কাজ। এবার অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান।
নতুন ছবি নিয়ে আসছেন মানস মুকুল। ছবির নাম 'চণ্ডীকথা'। সবচেয়ে বড় চমক হল, এবার তাঁর ছবির নায়ক 'সহজ পাঠের গপ্পো'-র সেই দুই শিশুশিল্পী। আবারও পরিচালকের ছবিতে কাজ করবেন সামিউল আলম ও নুর ইসলাম। যদিও এখন তাঁরা রীতিমতো তরুণ হয়ে উঠেছেন।
পঞ্চাশের দশকে মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের এই গল্পটি দুই কিশোর বন্ধুর জীবনযুদ্ধকে তুলে ধরবে। এক মুচি সম্প্রদায়ের ছেলে (সামিউল) ও এক ডোম সম্প্রদায়ের (নুর) ছেলে খুব কাছের বন্ধু। সেই সময়ের নিপীড়নমূলক সমাজ ব্যবস্থা, সেখানের প্রবল ভাবে উপস্থিত অস্পৃশ্যতা এবং অমানবিক জাতিভেদ প্রথা ফুটে উঠবে পর্দায়। সব রকম অত্যাচার, অন্যায়, শোষণ অতিক্রম করেও তাদের বন্ধুত্ব অটুট।
'চণ্ডীকথা' তৎকালীন সমাজের বর্বরতাকে প্রকাশ করে, যেখানে ছেলে দুটি কিছু ভয়ংকর কুসংস্কার, নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয় এবং তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর গোষ্ঠীর দ্বারা শোষিত হতে থাকে। তাদের পরস্পরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সমাজের কুসংস্কার এবং বিভাজনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। তাদের যন্ত্রণা, সংগ্রাম,ত্যাগ ও প্রতিবাদের মাধ্যমে, 'চণ্ডীকথা' হয়ে ওঠে নির্মম বৈষম্যের মাঝে ঐক্য এবং মনুষ্যত্ব উদযাপন । কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে ডুবে থাকা তৎকালীন নিষ্ঠুর সমাজের মাঝে একটি শিকল ভাঙার গান - 'চণ্ডীকথা'।
মানস মুকুল পাল জানালেন, "এই আধুনিক সময় দাঁড়িয়েও বর্ণ বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, নানা রকম জঘন্য কুসংস্কার আমাদের সমাজে আছে। কোথাও খুব প্রকট ভাবে আছে, কোথাও খুব প্রচ্ছন্ন ভাবে আছে। আমি বিশ্বাস করি এবং এটাই সত্যি যে, প্রতিটা মানুষ সমান। মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ নেই। এই বিভেদ, জাতপাতের নিয়ম কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে সৃষ্টি করে গেছে। এই জ্বাল থেকে বেরতে না পারলে, দেশ, সমাজের কখনও উন্নতি হতে পারে না। সেই জন্যই 'চণ্ডীকথা' বানানোর ভাবনা।"
দ্বিতীয় ছবি বানাতে প্রায় এক দশক সময় লাগল কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক বলেন, "ভাল যে কোনও কিছুর জন্য সময়ের প্রয়োজন। জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতার মতো একটা প্রচীন ঘৃণ্য প্রথা নিয়ে খাঁটি সিনেমা তৈরি করতে গেলে তার উৎস জানাটা খুব জরুরি। তার জন্য পড়াশোনা করা প্রয়োজন এবং সেটা সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার।"
ফের সামিউল ও নুরকে নিয়েই কেন ছবি বানাচ্ছেন? মানস জানালেন, "নুর, আলম দু'জনকেই ছোটবেলা থেকে অনেক ভালোবেসে, অনেক যত্ন নিয়ে অভিনয় শিখিয়েছি। অভিনয় যত কঠিনই হোক, শেখালে সেটা ধারণ করার ক্ষমতা ওদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই আছে। আর এই প্রক্রিয়াটা 'সহজ পাঠের গপ্পো' হয়ে যাওয়ার পরও থামেনি। ওরা দু'জনে বড় হয়েছে এত বছরে। মানুষ হিসাবেও, অভিনেতা হিসাবেও। ফলে আমার মনে হয়েছে, ওদের দু'জনকে নিয়ে আরও প্রকৃত চ্যালেঞ্জিং ছবি বানানো যেতে পারে...তাই নুর, আলমকে নিয়ে 'চণ্ডীকথা' শুরু করলাম।
প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে ছবির প্রি- প্রোডাকশনের কাজ চলছে। সব ঠিক থাকলে দুর্গা পুজোর পরে শ্যুটিং হবে। এরপর বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে এবং জাতীয় পুরস্কারের জন্য ছবিটা পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে পরিচালকের।