আজ আমরা কথায় কথায় পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করে গর্ব অনুভব করে থাকি। কিন্তু সেই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণভোমরার জন্মদিন অর্থাৎ সাধারণতন্ত্র দিবস নিয়ে আলোচনা তুলনামূলকভাবে কমই হয়। ২৬ জানুয়ারি এই দিনটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
আজ থেকে ৭১ বছর আগে দেশের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে মর্যাদা পেয়েছিল ভারত। ব্রিটিশ শাসনের প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৪৭ সালে ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় ভারতের কোনও নিজস্ব সংবিধান ছিল না। কিন্তু সংবিধানের প্রয়োজনীয় অনুভব করেছিলেন তৎকালীন প্রধানরা। আর সেই কারণেই বিআর আম্বেদকরের নতৃত্বে একটি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
সাত দশক আগে ২৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছিল ভারতের সংবিধান। তবে তার আগে কিন্তু এই দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হত। মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন স্বতন্ত্রতা সংকল্প দিবস। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯২৯ সালের বর্ষশেষে 'পূর্ণ স্বরাজ' আনার শপথ ঘোষণার পর ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভেঙে ভারত যেদিন বাস্তবেই স্বাধীনতার মুখ দেখল- সেইদিন ঘটনাচক্রে ছিল ১৫ অগাস্ট। যার ফলে পালটে গেল ২৬ জানুয়ারির গুরুত্বও।
তবে ১৯৫০ সালে দেশের সংবিধান প্রস্তুত হওয়ার পর, তা কার্যকর করতে প্রয়োজন হল একটি দিনের। তখনই ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের বিচারে বেছে নেওয়া হয় ২৬ জানুয়ারিকেই। এই কারণেই ২৬ জানুয়ারি পরিচিত হল ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবস হিসেবে।
মঙ্গলবার ৭২ তম সাধারণতন্ত্র দিবস। কিন্তু জানেন কি সংবিধানের মূল কপিটি কোথায় রয়েছে? কটি সেই কপি রয়েছে এবং সেগুলি কোথায় সংরক্ষিত রাখা আছে ? উত্তরটি হল, ভারতের সংবিধানের মূল কপি রয়েছে তিনটি। এই তিনটি কপিও রাখা আছে সংসদের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। সেখানে একটি সিকিউরিটি এনক্লোজার রয়েছে তিনটি ঘরের জন্য, সেটা পেরিয়ে অবশ্য় তা দেখা যায়।
সংবিধানের মূল কপিটি ২২ ইঞ্চি লম্বা এবং ১৬ ইঞ্চি চওড়া এবং পান্ডুলিপিটি ২৫১ পাতার। এটা করতে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন লেগেছিল। এই মূল কপিটিতে গণপরিষদের ২৮৪ জন সদস্য ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রথম স্বাক্ষরটা অবশ্য প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ করেননি, করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এই স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রাজেন্দ্র প্রসাদ সহ ৪৬জন হিন্দিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।স্বাক্ষরকারীদের মধ্য ১৫জন মহিলা ছিলেন। এদেশের সংবিধানই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় লিখিত সংবিধান।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারত স্বাধীন হয় এবং ২৯ অগাস্ট সংবিধান রচনার জন্য একটি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়। ড: বি আর আম্বেদকর এই কমিটির সভাপতি ছিলেন। খসড়া কমিটি ১৯৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করে। এরপর দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা এবং সংশোধনের পর ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধানটি গৃহীত হয়। এই সংবিধানে মোট ৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তপশিল ছিল। গণপরিষদের সভাপতি হিসেবে ড: রাজেন্দ্র প্রসাদ এই সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। এই সংবিধান তৈরিতে মোট সময় লেগেছিল ২ বছর ১১ মাস ১৭ দিন। অন্য কোনও দেশের সংবিধান রচনাতে এত সময় লাগেনি। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই অধিবেশনেই ড: রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে স্বরাজ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তার মধ্যেই গণপরিষদের দাবি নিহিত ছিল। ১৯২২ সালে গান্ধীজি ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ভারতবাসীর জন্য সংবিধানের অপরিহার্যতার কথা বলেছিলেন। স্বরাজ্য দল কেন্দ্রীয় আইনসভার ভিতরে এবং বাহিরে সংবিধানের দাবি জানিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে জহরলাল নেহেরু জানিয়েছিলেন, জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীন ভারতের জন্য একটি সংবিধান চায় যা প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত গণপরিষদের মাধ্যমে রচিত হবে। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচকমণ্ডলী ছিলেন প্রাদেশিক আইনসভায় সদস্যবৃন্দ।
গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৮৯ জন। এর মধ্যে দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধি ছিলেন ৯৩জন। বাকি ২৯৬টি আসনের ২০৮টি জেতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ জিতেছিল ৭৮টি আসন। দেশিয় রাজ্যের কোনও প্রতিনিধি অবশ্য নির্বাচিত হননি। সংবিধান রচনা ও গণপরিষদের পরিচালনার মূল কর্তৃত্ব ছিল চারজনের হাতে। তাঁরা হলেন- বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং মৌলানা আজাদ । আর খসড়া সংবিধান রচনার একক দায়িত্ব ছিল ড: আম্বেদকরের উপর। ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর নতুন দিল্লির কনস্টিটিউশন হলে বেলা এগারোটায় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। মুসলিম লিগের প্রতিনিধিরা তাতে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের অনুপস্থিতিতে ২০৭ জন প্রতিনিধি নিয়ে সভার কাজ শুরু হয়।
এই বিশেষ দিনটি কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার সহ বেসরকারি সংস্থাগুলির উদ্যোগে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মূল অনুষ্ঠান হয় দেশের জাতীয় রাজধানী দিল্লির রাজপছে। সেখানে সকালে কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্ডিয়া গেটের অমর জওয়ান জ্যোতিতে সেনা শ্রদ্ধা জানান। সেখানে থেকেই শুরু হয় অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপতি রাজপথে পতাকা উত্তোলন করেন। তারপরই শুরু হয় বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ। যেখানে দেশের নৌ বাহিনী, স্থলবাহিনী ও বিমান বাহিনী শক্তিপ্রদর্শন করে। রাষ্ট্রপতি এদিন সামরিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিক ও শিশুদের বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য পুরষ্কার প্রদান করেন।