অপেক্ষার পালা শেষ। ভারতের তৈরি প্রথম নিজস্ব প্রযুক্তি ও ক্ষমতায় তৈরি বিমানবাহী রণতরী,আইএনএস বিক্রান্ত,আজ শুক্রবার কোচিন শিপইয়ার্ডে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে উদ্বোধন হয়ে গেল ৷ আইএনএস বিক্রান্ত হল ভারতের সামুদ্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যায়বহুল ও দামী জাহাজ। এটি তৈরিতে খরচ পড়েছে ২০,০০০ কোটি টাকা। সময় লেগেছে ১৩ বছর। এদিন ভারতীয় নৌবাহিনীর নতুন প্রতীকও উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রতীক অতীতের ঔপনিবেশিক ছোঁয়া থেকে মুক্ত, যা দেশীয় ও নিজস্ব পরিচয় বহন করছে। একটি প্রতিরক্ষা বিবৃতিতে বলা হয়েছে,'বিক্রান্ত'-এর কমিশনিং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি দেশের স্বদেশীকরণের ক্ষমতা প্রদর্শন করবে।
এদিন উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আইএনএস বিক্রান্তের পাশাপাশি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ছোঁয়াচও দূর হচ্ছে। আজ থেকে ছত্রপতি শিবাজীর অনুপ্রেরণায় সমুদ্রে ও আকাশে উড়বে নৌবাহিনীর নতুন পতাকাও। এর উদ্বোধনের সঙ্গে ভারত উন্নত দেশগুলির সঙ্গে একাসনে বসবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজি সামুদ্রিক শক্তির জোরে এমন একটি নৌবাহিনী তৈরি করেছিলেন,যা শত্রুদের কাছে আতঙ্ক ছিল। ব্রিটিশরা ভারতে এলে ভারতীয় জাহাজের শক্তি এবং তাদের মাধ্যমে বাণিজ্যের কারণে তারা ভয় পেত। সেই ইতিহাসকে স্মরণ করে এটির প্রতীক ডিজাইন করা হয়েছে। এটিকে আত্মনির্ভর ভারতের প্রতীক বলেও বর্ণনা করেন তিনি।
এই জাহাজের ওজন কত জানেন?
এই যুদ্ধজাহাজে আইফেল টাওয়ারের সমান ওজনের স্টিল এবং লোহা ব্যবহার করা হয়েছে, আইএনএস বিক্রান্তের ওজন ৪৫ হাজার টন অর্থাৎ এটি বানাতে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের তার চার গুণ ওজনের লোহা এবং স্টিল লেগেছে। শুধু তাই নয় এর দৈর্ঘ্য ২৬২ মিটার এবং চওড়া ৬২ মিটার অর্থাৎ এটি একটি ফুটবলের মাঠের সমান আয়তন। এটি ভারতের প্রথম স্বদেশী যুদ্ধ জাহাজ যাতে ৭৬ শতাংশ স্বদেশী উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে ৪৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত মারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্রহ্মস মিসাইল মোতায়েন থাকবে। এর মধ্যে ২৪০০ কিলোমিটার কেবল লাগানো হয়েছে অর্থাৎ কোচি থেকে দিল্লি পর্যন্ত কেবল পৌঁছতে পারে।
একসঙ্গে ৩০ টি বিমান এখানে (বিক্রান্ত ইন্ডিজেনাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ক্রাফট) মোতায়েন থাকতে পারবে। এছাড়াও এর মধ্যে ফাইটার জেটও ওড়ানো যাবে। এটি অ্যান্টি এয়ার, অ্যান্টি সারফেস এবং অ্যান্টি ল্যান্ড এতে ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে কেমন ৩১ হেলিকপ্টার ওড়ানো যেতে পারে। বিক্রান্তের নৌসেনাতে শামিল হওয়ার পরে এখন ভারত সেই সমস্ত দেশের মধ্যে সামিল হয়ে গেছে, যাদের কাছে স্বদেশী বিমানবাহক জাহাজের ডিজাইন এবং নির্মাণের ক্ষমতা আছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর ভাইস চিফ ভাইস অ্যাডমিরাল এসএন ঘোরমাদে আগেই বলেছিলেন আইএনএস বিক্রান্ত ভারত-প্যাসিফিক এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অবদান রাখবে। তিনি বলেছিলেন যে আইএনএস বিক্রান্তে বিমান অবতরণের পরীক্ষা নভেম্বরে শুরু হবে এবং সেগুলি ২০২৩ সালের মাঝামাঝি শেষ হবে। মিগ-২৯ কে জেটগুলি প্রথম কয়েক বছর যুদ্ধজাহাজ থেকেই কাজ করবে। বিক্রান্তের মোতায়েন, প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের স্বনির্ভরতার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হচ্ছে।
জাহাজটিতে ফিজিওথেরাপি ক্লিনিক, আইসিইউ, ল্যাবরেটরি এবং আইসোলেশন ওয়ার্ড সহ সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি সহ একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কমপ্লেক্স রয়েছে। এটি দেশীয়ভাবে তৈরি অ্যাডভান্সড লাইট হেলিকপ্টার (এএলএইচ) এবং লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট (এলসিএ) ছাড়াও মিগ-২৯ কে ফাইটার জেট, কমভ-৩১ এবং এমএইচ-৬০আর মাল্টি-রোল হেলিকপ্টার সমন্বিত ৩০টি বিমানের এয়ার উইং পরিচালনা করতে সক্ষম।
'বিক্রান্ত' নির্মাণের মাধ্যমে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, চিন এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলির একই পংক্তিতে যোগ দিল। ভারতের এখন দেশীয়ভাবে একটি বিমানবাহী রণতরী ডিজাইন এবং নির্মাণের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। যুদ্ধজাহাজটি তৈরিতে ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তি এবং দেশীয় সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। বিক্রান্তের কমিশনিংয়ের সঙ্গে, ভারতের দুটি অপারেশনাল এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার থাকবে, যা দেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করবে।
২৮ নোট সামুদ্রিক মাইলের স্পিড
বিক্রান্তে ২২০০ কম্পার্টমেন্টের সঙ্গে ১৪ টি ডেক রয়েছে। যেখানে প্রায় ১৫০০ জওয়ানকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং তাদের খাওয়া-দাওয়ার সম্পূর্ণ বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। এর কিচেনে প্রায় দশ হাজার রুটি বানানো যাবে। এখানে ২৮৮ মেগাওয়াটের বিদ্যুতের চারটি গ্যাস টারবাইন লাগানো রয়েছে এবং এর অধিকতম গতি ২৮ সামুদ্রিক (নট) মাইল। এটির তৈরি তিন কিস্তিতে এগিয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ এবং অক্টোবর ২০১৯ এ ডিলটি সম্পন্ন হয়েছে। এটি আত্মনির্ভর ভারতের আদর্শ উদাহরণ যা মেক ইন ইন্ডিয়া স্লোগানকে সমৃদ্ধ করেছেন।