অতি বৃষ্টিতে জেরবার পাকিস্তান। এই বছর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের শুরু হয়েছে ভয়ানক বর্ষা। এ কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সঙ্কট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই বন্যা পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ বিপাকে পড়েছেন। ১০ লক্ষ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমরা অনেক সময় মনে করি কেদারনাথে বিপর্যয় ঘটলে অন্যান্য রাজ্যে কোনও যায় আসে না কিংবা কেরলে বন্যা হলে বাকি অন্য রাজ্যে তার কোনও প্রভাব পড়ে না। কিন্তু না, যখন নদীতে জলস্ফীতি ঘটে বর্ষার মরশুমে, তখন নদী নিজের রাস্তা নিজে তৈরি করা শুরু করে। তখন তার সামনে রাজ্য, দেশ, কোনওটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ভৌগোলিকভাবেই নদী নিজের গতিতে চলতে শুরু করে। উঁচু এলাকা থেকে নদীগুলি নীচু এলাকায় ঢাল অনুযায়ী বইতে শুরু করে। এখন পাকিস্তানের অবস্থা এরকমই। গিলগিট, বালুচিস্থান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ায় নদীর জল স্তর এতটা বেড়ে গিয়েছে যে পুরো দেশের নকশা সবুজ থেকে নীল হয়ে গিয়েছে।
নাসার আর্থ অবজারভেটারির ছবি জারি করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রত্যেক জোড়া ছবিতে একই জায়গার দু'রকম ফটো দেখানো হয়েছে। প্রথমটি ৪ অগাস্ট ২০২২ এর। যার মধ্যে দেখানো এলাকাটি শুকনো। অন্য ছবিতে ২৮ আগস্ট ২০২২ এর। এই ছবিতে একই জায়গা জলে ডুবে রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ ছবি সিন্ধু নদীর। পঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখাওয়া, বালুচিস্থান এবং সিন্ধু প্রদেশ দিয়ে জল বইছে।
সিন্ধু নদী হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়েছে। পাকিস্তানে হিমালয় এলাকায় ৭ হাজারের বেশি হিমবাহ রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত হিমবাহের তুলনায় হিমালয়ের হিমবাহ দশগুণ বেশি গতিতে গলছে। তার প্রভাবে সিন্ধু সমেত পাকিস্তানের একাধিক নদীতে হিমবাহ বাহিত জল পুষ্ট হয়ে বৃদ্ধি হচ্ছে। যাতে গোটা পাকিস্তানের দেড়শোর বেশি ব্রিজ, ৩৫০০ কিলোমিটার লম্বা সড়ক, এই বন্যায় জলমগ্ন হয়ে গিয়েছে।
নাসার স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ছবিতে ভিজিবেল ইন্ট্রারেড ইমাজিং রেডিও মিটার সুইট লাগানো রয়েছে। যা থেকে এই ছবিগুলি নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানে এত জল জমা হয়ে গিয়েছে, যেখানে পাকিস্তানে তিন ভাগের এক ভাগ অংশ সবুজ, হলুদ, ধূসর থেকে বদলে নীল হয়ে গিয়েছে। নদীর স্তর বেড়ে গিয়েছে। বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। সিন্ধু প্রান্তের কাম্বার এবং শিকারপুর এর পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়, এ বছর ৫০০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার খুব দ্রুত গলছে। এতে ভারত-নেপাল-চিন-বাংলাদেশ-ভুটান-পাকিস্তান সমেত একাধিক দেশে জলের সমস্যা হতে পারে। কারণ এই সমস্ত দেশের বেশিরভাগ নদীগুলি হিমালয়ের হিমবাহ থেকেই উৎপত্তি । যা গত কয়েক দশকে দশগুণের বেশি গতিতে গলছে।
বৈজ্ঞানিকরা ছোট হিম যুগের পরে এখন হিমালয়ের ১৪ হাজার ৭৯৮টি গ্লেসিয়ারের উপর গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞানীরা নিজেদের স্টাডিতে পেয়েছেন যে হিমবাহগুলি নিজের চল্লিশ শতাংশ অংশ হারিয়ে ফেলেছে। এটি ২৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে ১৯ হাজার ৬০০ কে বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলে এসে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হিমবাহ ৩৯০ কিউবিক কিলোমিটার থেকে ৫৯০ কিউব কিলোমিটার বরফ হারিয়েছে। এভাবে গলার কারণেই লাগাতার জল বেরোনো শুরু হয়েছে। যাতে গোটা পৃথিবীর সমুদ্রের জল স্তরের থেকে ১.৩৮ মিলিমিটার বেড়ে গিয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হিমবাহ হিমালয়তে রয়েছে। এই গতিতে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার গলতে থাকলে ভবিষ্যতে একাধিক এশিয় দেশে পানীয় জলের সমস্যা তৈরি হয়ে যাবে। জানা গিয়েছে যে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার সবচেয়ে বেশি নেপালে গলছে। পূর্ব নেপাল এবং ভুটানের এলাকায় এই গলনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এর পিছনে বড় কারণ হিমালয়ের পাহাড় এর দুটি অংশের আবহাওয়া বায়ুমন্ডলে পার্থক্য এবং মরশুম বদলে যাওয়া।
আরও একটি সমস্যার সামনে এসেছে। হিমালয়ে গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার গতি বাড়ায় একাধিক হ্রদ তৈরি হয়ে গিয়েছে যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। যদি হ্রদের দেওয়াল ভাঙতে শুরু করে তাহলে কেদারনাথ এর মতো বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটতে পারে বহু জায়গায়। হিমবাহ গলতে শুরু করলে নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলবে। তারপর একসঙ্গে একাধিক দেশ জলের সমস্যায় পড়ে যাবে। যাতে হাহাকার তৈরি হবে। চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে।