চলতি বছরে তরুণ রক্তের একের পর এক বিদ্রোহ দেখেছে ভারতীয় রাজনীতি। প্রথম আঘাত দিয়েছিলেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। রাহুল ব্রিগেডের এই তরুণ নেতা গত মার্চে দলবদল করেছিলেন। ঘটনার কেন্দ্রে সেই প্রবীণ-নবীন সংঘাত।
মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে যাওয়ায় গত মার্চে কংগ্রেস ছেড়েছিলেন মাধবরাও সিদ্ধিয়ার পুত্র জ্যোতিরাদিত্য। মধ্যপ্রদেশে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন কংগ্রেসের সরকার।
গত মার্চে ২২ বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেস ছাড়েন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে কমলনাথের সরকার। ফের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন বিজেপির শিবরাজ সিং চৌহান। শিবির বদল করার পর সদ্য শেষ হওয়া মধ্যপ্রদেশ উপনির্বাচনেও বাজিমাত করেছেন গোয়ালিয়রের মহারাজা। মুছে যায় কংগ্রেস।
জ্যোতিরাদিত্যের দল বদলের ঠিক চার মাসের ব্যবধানে তাঁর বন্ধু বিদ্রোহ করে বসেন রাজস্থানে। রাহুল গান্ধীর তরুণ ব্রিগেডের প্রথম সারির সদস্য সচিনেরও বিদ্রোহর পেছনে কারণ ছিল সেই প্রবীণ-নবীন সংঘাত। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলটের বিরুদ্ধে যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী সচিন পাইলট।
সচিনের বিদ্রোহের জেরে রাজস্থানের উপমুখ্যমন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় রাজেশ পাইলটের পুত্রকে। সচিন ঘনিষ্ঠদের ক্ষোভ ছিল , কংগ্রেসকে কার্যত কাঁধে করে রাজস্থানে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেও মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি পাননি তিনি। উল্টে তাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে গেছেন গেহলট।
২০১৮ সালে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের জয়ে বড় ভূমিকা ছিল সচিন পাইলট ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার। কিন্তু দুই রাজ্যেই প্রবীণ মুখকে প্রাধান্য দেয় কংগ্রেস। সেই সময় দু'জনের চাপা ক্ষোভ সামাল দিতে আসরে নামতে হয় রাহুল গান্ধীকে। তখনকার মতো পাইলট ও সিন্ধিয়ার মানভঞ্জন হলেও পরে সেই ছাই চাপা আগুন ফের প্রকাশ্যে চলে আসে। সচিনকে শেষপর্যন্ত দলে আটকে রাখা গেলেও শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে যোগ দেন জ্যোতিরাদিত্য।
বাংলার রাজনীতিতে এখন নন্দীগ্রামের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে জোর চর্চা চলছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সেই জল্পনা নিজেই আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহণ দফতরের পাশাপাশি সেচ দফতর সামলাতেন শুভেন্দু অধিকারী। এই দুটি দফতরের মন্ত্রিত্ব থেকেই ইস্তফা দেন তিনি। শুধু তাই নয় যে জেড ক্যাটাগেরির সরকারি নিরাপত্তা এতদিন তিনি পেতেন তাও পরিত্যাগ করেন শুভেন্দু। এইচআরবিসি–র চেয়ারম্যান পদ থেকেও ইস্তফা দেন ।
এখানেই থেমে নেই তৃণমূল-শুভেন্দু অধ্যায়। চলতি সপ্তাহের মঙ্গলবার তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে হাইপ্রফাইল বৈঠকে বসেন শুভেন্দু। পরের দিনই বর্ষীয়াণ সাংসদ সৌগত রায়কে হোয়াটসঅ্যাপে নন্দীগ্রামের বেতাজ বাদশা জানিয়ে দেন একসাথে কাজ করা মুশকিল। আমাকে মাফ করবেন।
তবে শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের মধ্যে জল্পনা বহুদিন ধরেই তুঙ্গে ছিল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে শুভেন্দু অধিকারী আর থাকবেন নাকি বিজেপিতে যোগ দিয়ে তৃণমূলকে জোর টক্কর দেবেন, সেই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বহুদিন ধরেই জল্পনা চলছিল। বস্তুত বিগত তিনমাস ধরে দলের ছাতায় না থেকে সমান্তরাল জনসংযোগ ও প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক।
তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দলকে এই জায়গায় নিয়ে আসার পেছনে শুভেন্দু অধিকারীর মত নেতার যে যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দলের ভেতর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রষান্ত কিশোরের বাড় বড়ন্তই শুভেন্দুর দূরত্বের মূল কারণ বলেই জানা যাচ্ছে। যেভাবে অভিষক-প্রাশন্ত দল চালাচ্ছেন তা না পসন্দ ছিল শুভেন্দুর।
শুভেন্দু অধিকারীরে অভিমান প্রথমে নজরে আসে চলতি বছর মার্চে। সেবার নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সভায় গরহাজির ছিলেন তৃণমূলের অন্যতম প্রথম সারির নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তখনই পূর্ব মেদিনীপুরে অধিকার বাড়ির সদস্যের অনুপস্থিতি নিয়ে তুমুল জল্পনা শুরু হয় বঙ্গ রাজনীতিতে। তবে সেই সভায় শুধু শুভেন্দুই নন, শিশির, সৌমেন্দু অধিকারীরাও গরহাজির ছিলেন।
কিছুদিন আগে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক রদবদল করেন দল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই রদবদলে দলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্তৃত্ব আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং দলনেত্রী তাতে সিলমোহর দিয়েছেন। ফলে তিনিই এখন দলে অঘোষিত নাম্বার টু এ কথা সকলেই বুঝে গেছেন। যাঁরা এখনও তা মানতে পারছেন না তাঁদের অভিষেক নিজেই সে কথা জোরের সঙ্গে জানিয়ে দিতে দ্বিধা করছেন না।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বাড়বাড়ন্ত মেনে নিতে পারছেন না দলের বহু প্রবীন নেতা। এক সময়ে দলের নাম্বার টু মুকুল রায়ও দল ছেড়েছিলেন যে সব কারণে তার মূলে ছিল অভিষেকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। বহু পোড় খাওয়া নেতার বক্তব্য,অভিষেকের অপরিণত রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং মন্তব্যের কারণে দলকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। বিশেষ করে অভিষেকের বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত গড়ার ডাক এবং নির্বাচনে ব্যাপক রক্তপাত, মৃত্যু, দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে জনমানসে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে পঞ্চায়েতে বহু দুর্নীতির ফলেই ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়।
২০২১ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অগ্নিপরীক্ষায় বছর। বিজেপির চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে এবার জয় ছিনিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বাংলায় হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে ঘূটি সাজাতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী পড়েছেন বিপাকে। এই অবস্থায় রবিবার ৬ ডিসেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে শুভেন্দু অধিকারী কী ঘোষণা করবেন সেই দিকেই এখন তাকিয়ে গোটা রাজ্য। মন্ত্রীত্বের পর এবার দল ছাড়বেন কিনা নন্দীগ্রামের বেতাজ বাদশা তার ওপর আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপি দুই শিবিরের রণনীতিই অনেকটা নির্ভর করছে।