
করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে কার্যত ত্রাহি ত্রাহি রব দেশ জুড়ে। একদিনে সংক্রমণের দৈনিক রেকর্ড আর তারসঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যু মিছিল। দেশে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হলেও তাতেও দেখা দিয়েছে আকাল। করোনা সংক্রমণ থেকে কবে যে মুক্তি মিলবে। এ উত্তর এখনও অজানা। আর এসবের মাঝেই একটি খবর সকলের নজর কেড়েছে। তা হল করোনা দেবীর মন্দির। করোনা থেকে বাঁচতে এখন করোনা দেবীই ভরসা। আর সেই বিশ্বাসকে পাথেয় করেই করোনা দেবীর মন্দির তৈরি হয়ে গেল তামিলনাড়ুতে। কোয়েম্বাতুরের একদল মানুষ রীতিমতো মূর্তি বসিয়ে শুরু করেছেন করোনা দেবীর পুজো। কোয়েম্বাতুর থেকে কিছু দূরেই কামাতচিপুরম গ্রামে তৈরি হয়েছে মন্দিরটি। মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী করোনা দেবীর মূর্তিটি গ্র্যানাইট পাথরের তৈরি। দেড় ফুটের প্রতিমার পরনে টকটকে লাল রঙের শাড়ি। একহাতে ধরা ত্রিশূল।
গত বছর জুনে কেরলেও এরকম করোনা দেবীর পুজো করা হয়েছিল। এবার একই চিত্র দেখা গেল তামিলনাড়ুতে। তবে ভারতের ইতিহাস দেখলে কিন্তু এই ঘটনা বিরল নয়। শতাধিক বছর আগে ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারি প্লেগ। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তাতে। বছরের পর বছর ফিরে আসে এই মহামারি। অনেকটা করোনার মতোই। সেই সময় প্লেগের উদ্দেশে একটি মন্দির তৈরি করা হয়েছিল কোয়েম্বাতোরে। নাম দেওয়া হয়েছিল "প্লেগ মারিয়াম্মান মন্দির।" তাতে মূর্তিও স্থাপন করা হয়।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় অতীতে নানা রোগভোগের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে মানুষকে। তাতে জীবনের নানা ক্ষেত্রে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন নানা দেবদেবী। আর তার সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে নানা ধর্মের প্রচলন। আর সেই তালিকায় অধুনা নবতম সংযোজন করোনা দেবী। একদিকে অক্সিজেন ও ভ্যাকসিনের অভাব অন্যদিকে বেড়ে চলা সংক্রমণ, এই আবহে অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, এখন তাহলে ভগবানই ভরসা! সংক্রমণের রেখচিত্র থিতিয়ে আসার বদলে বরং আশঙ্কাজনকভাবে ঊর্দ্ধমুখী। রোগ-প্রতিরোধ বা নিরাময়ের হদিশ এখনও অধরা। অভূতপূর্ব সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে তাই শেষ আশ্রয় সব অগতির গতি ভগবান। তেত্রিশ কোটি দেবতাতেও যদি অকুলান হয় তো বিপদ কাটাতে ভক্তের ভগবান দেখা দিচ্ছেন নবতর রূপে। তবে শুধু তামিলনাড়ু নয় ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, জামশেদপুর, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তরাখন্ড এবং আমাদের এই বাংলার কাঁচরাপাড়া ও রায়গঞ্জেও বিপুল উদ্যমে শুরু হয়ে গেছে করোনা মাতার পুজো। মানুষের বিশ্বাসের সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে, রাখে হরি, মারে কে? অতীতে মহামহারিকে জিততে যেসব দেবীর স্মরণ নিয়েছিল মানুষ চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই তালিকা।
শীতলা
মহামারির আবহেই কিন্তু জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন মা শীতলা। পুরাণ কাহিনিতে দেখা যায়, দুর্গা কাত্যায়ন মুনির ছোট্ট মেয়ে হয়ে জন্ম নেন এবং তাঁর শৈশবের বন্ধুদের কলেরা, উদরাময়, হাম, গুটিবসন্ত ইত্যাদি নানান ব্যাধি থেকে রক্ষা করেন। এই কাত্যায়নীর আর এক রূপ হল শীতলা। ব্রহ্মার কন্যা এবং কার্ত্তিকেয়ের স্ত্রী হিসেবেও শীতলাকে দেখা যায়। পুরাণ ছাড়াও এই দেবী আছেন সহজ সরল লোককথায়, যেমন শীতলা কথা, মঙ্গলকাব্য। আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় কবি মানিকরাম গাঙ্গুলি, দ্বিজ হরিদেব বা কবি জগন্নাথ, এমনকী আরও এক শতাব্দী আগে কবি বল্লভ এবং কৃষ্ণরাম দাস শীতলার বন্দনা করেছেন। যাঁরা মনে করেন, শীতলা নিতান্তই গ্রামের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের আরাধ্য স্থানীয় দেবদেবীর এক জন, তাঁদের জানা নেই, তিনি গোটা ভারতে পূজিত হন। ভারতবাসীরা কী ভাবে শীতলা পুজো করে গুটিবসন্তের বিভীষিকা থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করত, ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরা তা বিভিন্ন সময়ে দেখিয়েছেন।
ওলাইচণ্ডী
ওলাইচণ্ডী বা ওলাদেবী হলেন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে পূজিত এক লৌকিক দেবী। মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে ইনি ওলাবিবি নামে পরিচিত। লোকবিশ্বাস অনুসারে, ইনি ওলাওঠা (কলেরা) রোগের দেবী এবং ময়াসুরের পত্নী। ময়াসুর হিন্দু পুরাণের অসুর, দানব, রাক্ষস ও দৈত্যদের রাজা ও স্থপতি। ভক্তেরা ওলাইচণ্ডীকে কলেরার হাত থেকে ত্রাণকর্ত্রী দেবী মনে করেন। রোগ ও মহামারীতে আক্রান্ত অঞ্চলে তাঁর পূজা হয়। এই নামটি এসেছে বিবির গান আখ্যান থেকে। এই আখ্যান অনুসারে, তিনি এক কুমারী মুসলমান রাজকন্যার সন্তান। তিনি অলৌকিক উপায়ে অদৃশ্য হয়ে যান এবং পরে দেবী রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের কারণ ছিল তাঁর দাদামশাইয়ের (‘বাদশা’) ও রাজ্যের মন্ত্রীদের সন্তানদের আরোগ্য দান। ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির মূর্তি প্রধানত দুই প্রকারের। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এই দেবীর রূপ লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অনুরূপ। তাঁর গায়ের রং হলুদ, মুখ সুন্দর, দ্বিনয়না বা ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিনয়না, এলোকেশী অথবা মুকুট-পরিহিতা, বিভিন্ন অলংকারে সুসজ্জিতা, পরনে শাড়ি ও দণ্ডায়মান। কোথাও কোথাও দেবী ষষ্ঠীর ন্যায় কোলে শিশু-সহ উপবিষ্ট দেবীমূর্তিও দেখা যায়। তবে কোনও বাহন দেখা যায় না বা সম্প্রসারিত দুই হাতে কোনও বিশেষ মুদ্রাও প্রদর্শিত হয় না। মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে দেবীমূর্তির পরিধানে থাকে পিরান ও পাজামা, মাথায় টুপি ও পায়ে নাগরা জুতো। সেক্ষেত্রেও দেবীকে বিভিন্ন অলঙ্কারে সজ্জিতা হিসেবে দেখা যায় এবং তাঁর হাতে থাকে আসাদণ্ড।
সাতবিবি
সাত বোন বা সাতবিবি এমনই এক ধরণের দেবী বৃন্দ। যাদের কাছে মানত করলে বা ভক্তিভরে পুজো দিলে মহামারি থেকে পরিত্রাণের উপায় পাওয়া যায়। এমনকি রক্ষা পাওয়া যায় কঠিন রোগ থেকেও। এই বাংলা ও ওপার বাংলায় বহু জায়গায় একটি বেদীতে সাতটি দেবী মূর্তি একসঙ্গে বসিয়ে পুজো হয়। আঞ্চলিক বিশ্বাস, এরা প্রত্যেতেই এক একটি রোগের অধিষ্ঠাত্রী। মুসলমানদের মধ্যেও সাতবিবির আরাধনা দেখা যায়।
মানুষের অন্ধ বিশ্বাসই আজও বাঁচিয়ে রেখেছে লৌকিক দেবদেবীদের। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে যেভাবেই হোক আমরা মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছি। কিন্তু কেমনভাবে মিলবে সেই মুক্তি তা অজানা। প্রাচীনকালেও বিপদের সম্মুখী হয়েছে মানবজাকি, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতেন তাঁরা, আসত মহামারিও। তখন বিজ্ঞানের এত বাহুল্য ছিল না। ছিল না আধুনিক প্রযুক্তিও। মানুষের সম্বল বলতে ছিল শুধুমাত্র বিশ্বাস। তারা নিজেদেরকে সঁপে দিতেন ঈশ্বরের পায়ে। তাদের বিশ্বস ছিল ঈশ্বরই মুক্তি দেবে সমূহ বিপদ থেকে। আধুনিক ভারতও করোনা মহামারি থেকে মুক্তি পেতে তবে কি সেই ভগবানেই ভরসা রাখতে চলেছে!