ভারতীয় রাজনীতিতে গত ৮ বছরে ক্ষমতাসীন দল শক্তিশালী থেকে শক্তিশালীতর হয়েছে এবং মোদীর ক্ষমতা বিরোধীদের ক্রমশ দুর্বল করে দিয়েছে। কয়েকটি ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধীদের পরাজয়, আর শুধুই পরাজয় দেখা গিয়েছে। পরিস্থিতি এমনটাই তৈরি হয়েছে, যেন একটি বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত ছোটখাটো কিছু গাছ, যেগুলি না ওপরে উঠতে পারছে, না সূর্যালোক পাচ্ছে। দিন দিন শেওলার মতো পরিস্থিতি হচ্ছে।
তবে বট ও শেওলার মতো এই পরিস্থিত সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয় না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলানোর দায়িত্ব থাকে বিরোধীদের ওপরে। কারণ ক্ষমতায় থাকা দল বটের মতোই থাকতে চায়। তারই মাঝে মাথা তুলে দাঁড়ানোর দায়িত্ব থাকে বিরোধীদের ওপরে। আর তারজন্য বিরোধীদের কাছে থাকতে হয় ৩টি অস্ত্র, ইস্যু, রণনীতি ও জনগণ।
বর্তমানে বিরোধী দলের দিকে তাকালে মনে হয় তারা অন্যমনষ্ক। যেন খেলতে চায় না। যুদ্ধ করতে চায় না। তারা কী চায় কে জানে! তাদের কোনও স্পষ্টতা আছে বলে মনে হয় না। না কোনও স্পষ্টতা আছে, না কোনও সংকল্প আছে, না কোনও সক্রিয়তা আছে। যেন তাঁরা কোনও ঐশ্বরিক অনুকম্পার অপেক্ষায় স্বপ্ন দেখছেন।
দেশে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আবহ চলছে। আর সেখানে বিরোধী দলকে ফের একবার মুষিক-সভায় ঘণ্টা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। এই বিষয়ে সহমতের জন্য ঘণ্টা বাঁধা দরকার। কিন্তু এই নির্বাচনেও বিরোধীদের কাছে কোনও বার্তা নেই, শুধুই মনোবল হারিয়ে বসে থাকা ছাড়া।
রয়েছে বেশকিছু বিভ্রান্তি
প্রথমে আসা যাক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিষয়ে। এই নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। সেখানে রিং মাস্টারের ভূমিকায় দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে। প্রথমে গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর নাম নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি রাজি না হলে শারদ পাওয়ারসহ আরও কয়েকজনের নাম নিয়ে আলোচনা হয়।
ফলাফল হিসেবে যে নাম উঠে এল, তাঁকে না বিরোধীরা বুঝতে পারলেন, না বিরোধীদের সমর্থনকারীরা। যশবন্ত সিনহা এমন একজন মানুষ যিনি বিজেপি ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছেন। একসময় অনেক বিরোধী দল তাঁর বক্তব্য ও কটাক্ষের শিকার হয়েছে। আর তাঁর নাম ঘোষণার মধ্যে কোনও রাজনৈতিক বার্তা আছে বলেও বোঝা যায়নি। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, যশবন্ত সিনহা খুবই দুর্বল প্রার্থী। অন্যদিকে, দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে এত বেশি রাজনৈতিক ফ্যাক্টর জড়িয়ে রয়েছে যে তাঁর বিরোধিতা করাও সহজ নয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের প্রার্থী ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনটি আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলনের হিসেবে মনে হচ্ছিল। মেহবুবা মুফতিকে পাশে বসিয়ে, কাশ্মীর নয়, বাংলার মুসলমানদের বার্তা দিতে দেখা যায় মমতাকে। যশবন্ত সিনহাও প্রার্থী হওয়ার পর কোনও জোরালো রাজনৈতিক বার্তা দিতে পারেননি। এক কথায় বলতে গেলে যশবন্ত সিনহাকে এই সময় এমন কিছুই করতে দেখা যায়নি যা মানুষ মনে রাখবেন। বিরোধী দলগুলিও যেন প্রার্থী ঘোষণার পর নিদ্রায় চলে যায়। অন্যদিকে একের পর এক আসতে থাকে দ্রৌপদী মুর্মুর সক্রিয়তার খবর।
পাশাপাশি উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেই একই অবস্থা। এনডিএ জগদীপ ধনখরকে প্রার্থী করার পর বিরোধীরা মার্গারেট আলভার নামে শীলমোহর দেয়। আলভা একসময় কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী থাকলেও পরে গান্ধী পরিবারের কট্টর বিরোধী বলেই পরিচিত।
ধনখরের ভাবমূর্তি সরল নয়, তবে তাঁকে আলভার চেয়ে ভাল বলে মনে করা হচ্ছে। আলভার মনোনয়নের পেছনে ঠিক কোন রাজনৈতিক সমীকরণ থাকতে পারে তা এখনও বোধগম্যের বাইরে। কংগ্রেসের ভোটাররা, যাঁরা নিজেদের গান্ধী পরিবারের ভক্ত বলে মনে করেন, তাঁরা কীভাবে আলভাকে ভোট দেবেন সেটাও বোঝা মুশকিল।
বিরোধীরা যা হারালেন...
বিরোধীরা এই নির্বাচনে অনেক কিছু জিততে পারতেন। তাঁদের প্রার্থী যদি জয়ী নাও হন, তা সত্ত্বেও এনডিএ-কে চাপে রাখা যেত। রাজনীতিতে জয়ের আগে জয়ের মতো ভাবমূর্তি থাকা প্রয়োজন। আর জয়ের ভাবমূর্তি তখনই তৈরি হয় যখন জেতার মতো রণনীতি, প্রস্তুতি ও মুখ থাকে। তাতে লড়াই সমানে সমানে হয়।
এটা উপলব্ধির লড়াই। এখানে হেরেও লড়াই জেতা যায়। সেক্ষেত্রে এমন কীসের অভাব হল যে এই দুটি মুখের ওপরেই ভরসা রাখতে হল বিরোধীদের? এমনকী রয়েছে এই দুটি মুখে যে তাঁদের প্রার্থী করার ভাবনা এল বিরোধীদের? একজন ক্রীড়াবিদ, একজন ভারতরত্ন বা নোবেল প্রাপক, একজন প্রান্তিক মুখ বা পরিবর্তনের মুখ, একজন বুদ্ধিজীবী বা সামাজিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর... এমন অনেক বিকল্প ছিল যা বিরোধীরা ভাবতে পারতেন।
হয়তো এই ধরণের প্রার্থীরা পরাজিত হতেন, কিন্তু জনগণের মধ্যে বিরোধীরা সম্মান পেতেন। বর্তমানে যে প্রার্থীদের ওপরে কার্যত বিরোধীদের সমর্থকেরাই হাসাহাসি করছেন, তার পরিবর্তে অন্য কোনও মুখ আনলে ক্ষমতাসীন দল ও জনগণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করা যেত। কিন্তু দুঃখজনকভাবেই বিরোধীরা সেই সুযোগ হাতছাড়া করলেন।
এট শুধু নির্বাচনে নয়, রণনীতিতেও বিরোধীদের পরাজয়। জনগণের কাছে এই বিরোধীরা অস্পষ্ট। হয় এই বিরোধীরা লড়তে চায় না, নয় ফলাফলের ভয়ে লড়াইয়ের আগেই অস্ত্র সমর্পণ করে দেয়। বিরোধীদের হার গণতন্ত্রে বিরোধীদের গুরুত্বের পরাজয়। আর এর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ আর কিছু না হোক, বিরোধীদের অবশ্যই বিরোধী ভূমিকা পালন করা উচিত।
আরও পড়ুন - বাংলার রাজ্যপাল নকভি? অভিনন্দন জানিয়ে ট্যুইট BJP MP-র, পরে ডিলিট