ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৮১ তম বার্ষিকী। ভারত ছাড়ো আন্দোলন অগাস্ট আন্দোলন নামেও পরিচিত। এটি স্বাধীনতার প্রচেষ্টায় ঐক্য, ত্যাগ এবং সংকল্পের প্রতীক হিসাবে আপামর ভারতীয়ের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান অর্জন করেছে।
৯ অগাস্ট ১৯৪২-এ মহাত্মা গান্ধীর 'ডু অর ডাই' স্লোগানের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। এই দিন থেকেই দেশবাসী নতুন করে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখার সাহস খুঁজে পেয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের দাবিতে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় রাস্তায় নেমেছিলেন। এটি ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসাবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। অহিংস আন্দোলন এবং গণ-বিক্ষোভের ঢেউয়ে এই আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলা
১৭ অগাস্ট হাওড়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। স্তব্ধ হয়ে যায় ভারত জুট মিল, ইন্ডিয়া মেশিনারি ফ্যাক্টরি, হাওড়া জুট মিল, অনন্তরাম চ্যাটার্জী অ্যান্ড কোম্পানি, বিজয় বার্ন কোম্পানি, গেস্টকিন উইলিয়াম লিমিটেড, ফকিরদাস মিস্ত্রি অ্যান্ড কোম্পানি, কে দাস অ্যান্ড কোম্পানি ইত্যাদি বড় বড় কারখানা। এই ধর্মঘট, আন্দোলন চলেছিল ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সেই সময়ে হুগলিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। চুঁচুড়াতে ও শ্রীরামপুরে ধর্মঘট পালিত হয়। শুধু তাই নয়। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করতেও অস্বীকার করেন অনেকে। শ্রীরামপুর ও চুঁচুড়া বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনাররা পদ থেকে ইস্তফা দেন। হুগলি কটন মিল, রামপুরিয়া কটন মিল, বঙ্গলক্ষী কটন মিল, বঙ্গেশ্বরী কটন মিল, হিন্দুস্তান বেল্টিং ওয়ার্কস, বেঙ্গল বেল্টিং ওয়ার্কসের মতো কারখানায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এই কারখানাগুলি ব্রিটিশ সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। ফলে যুদ্ধের আবহে আয় কমে যাওয়ায় ঘুম উড়ে যায় ব্রিটিশ সরকারের। রেললাইন ধ্বংস, সরকারি নথি পোড়ানো, টেলিফোন লাইন কাটার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাজকর্ম শিকেয় তুলে দেওয়া হয়।
একইভাবে বর্ধমানের কালনা, জামালপুর, ভান্ডারহাটি, কাশীয়ারা, উচালন, মণ্ডলগ্রামে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বাঁকুড়ায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সাঁওতালরাও অংশ নেয়।
পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময়ে যুদ্ধের কারণে ব্রিটিশ সরকারের সম্পদ তলানিতে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। জাপান ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ব্রিটিশরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের অধিকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে ব্রিটিশ শাসনের দুর্বলতা ধরে ফেলে ভারতীয়রা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে। মুদ্রাস্ফীতির মতো যুদ্ধ সংক্রান্ত অসুবিধার কারণে জনসাধারণও ক্ষুব্ধ ছিল। উপনিবেশগুলি থেকে শোষণ বাড়িয়ে যুদ্ধের খরচ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল ব্রিটিশরা। এমন সময়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের সাক্ষী হয়েছিল।
এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল অবিলম্বে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। ভারতকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার দাবি তোলে জাতীয় কংগ্রেস।
ডু অর ডাই: ৮ অগাস্ট ১৯৪২ মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিখ্যাত 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' বার্তা দেন। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার ডাক দেন মহাত্মা গান্ধী।
জন আন্দোলন: সমাজের প্রতিটি স্তরে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নিবিশেষে এমন স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন এর আগে হয়নি।
ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন রুখে দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা করে। হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়।
নেতাদের গ্রেফতারি: জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেলের মতো নেতাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। তাঁদের জেলবন্দি করা হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ফলাফল
এই আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ শাসনের ভিত নড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এমন গণ-আন্দোলনের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও ব্রিটেনের উপর চাপ সৃষ্টি করা শুরু হয়।
টার্নিং পয়েন্ট
ভারত ছাড়ো আন্দোলনই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করা হয়। এই আন্দোলনই বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার ও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে আলোচনার জায়গাটা তৈরি করে দেয়।