আজ উল্টোরথ। এবার প্রভু জগন্নাথ তার মাসির বাড়ি থেকে নিজের আবাসে ফিরবেন। অর্থাৎ ফেরার পালা শুরু হবে। দুরত্ব বেশি নয়,কিন্তু ধীরগতিতে রথ চলতে চলতে এসে পৌঁছেবে মূলমন্দিরে। যাত্রার সমাপ্তি আগামিকাল অর্থাত্ মঙ্গলবার। শুরু হবে নুতন ঐশ্বর্যের,নুতন রাজবেশ ধারণ করার প্রক্রিয়া। তারপরে সেই রাজবেশ ধারণ করে প্রভু জগন্নাথ নিজের মন্দিরে অধিষ্ঠিত হবেন। উৎকলবাসী ভীষণভাবে এই জগন্নাথদেবের জীবনযাত্রার সঙ্গে যেন যুক্ত। জগন্নাথদেবে যেন সত্যি সত্যি একটা মানুষ। একেই তো বোধহয় বলে দেবতার মানবায়ন। শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করার জন্যে মেঘনাদ প্রাচীরের গাঁয়ে চারদিকে চারটি দ্বার আছে। এই মন্দির ৮০০ বছর একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে,সেও তো এক রহস্য। প্রাচীন মন্দিরের নির্মাণ যে প্রণালী তাকে বলা হয় ত্রিরথ,পঞ্চরথ,সপ্তরথ,নবরথ প্রণালী। শ্রীজগন্নাথ মন্দির পঞ্চরথ প্রণালীতে গঠিত। মন্দিরের উচ্চতা ২১৪.৮ ফুট, ক্ষেত্রফল ১০.৭ একর। মন্দিরের গায়ে আলস্য কন্যা, মৈথুন চিত্র, রাজদরবার,অষ্টদিব্যপাল,পশু-পক্ষী এইসব দেখা যায়। এই মৈথুন চিত্র নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। অনেকের অনেক মত রয়েছে। অনেকে অবশ্য বলেন, মৈথুন চিত্র ভক্তের পবিত্রতা পরীক্ষার জন্য অঙ্কিত। অর্থাৎ মৈথুন চিত্র দেখে এই কাম-মোহ-মায়াজালকে ছিন্ন করে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে। তবে অনেক জগন্নাথ বিশ্বাসী বলেন এই মৈথুন চিত্র আসলে মন্দিরকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আসলে জগন্নাথধামকে কেন্দ্র করে সেই পুরাণের দিন থেকে নানান রকমের কিংবদন্তী, নানা রকমের কাহিনি আজ পর্যন্ত চলে আসছে।
এই দ্বার খুললে রক্তপাত হতে পারে
জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করার জন্যে মেঘনাদ প্রাচীরের গায়ে চারদিকে চারটি দ্বার। পূর্বদ্বার, উত্তরদ্বার,পশ্চিমদ্বার,দক্ষিণদ্বার। এই দ্বারগুলিকে যথাক্রমে সিংহদ্বার,ব্যাঘ্রদ্বার,হস্তিদ্বার এবং অশ্বদ্বার বলা হয়। অনেকের মতে, এই চারিদ্বার ধর্ম, ঐশ্বর্য, বৈরাগ্য এবং জ্ঞানের প্রতীক। এই চারটি পথ বাদ দিয়ে আরও একটি পথ অবশ্য আছে। যেটি একদম অব্যবহৃত। একে বলা হয় ‘টিকারা ঘোহেরী’। এই দ্বার খুললে রক্তপাত হতে পারে, গন্ডগোল বেঁধে যেতে পারে। এই শঙ্কায় চিরকালের জন্য এই পথ বন্ধ। এই চারটি দরজাও তো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। এবারের বিজেপির নতুন সরকার আসার আগেই ঘোষণা করেছিল তারা সব দ্বার খুলে দেবে ভক্তদের জন্য। এবার দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে। সিংহ দ্বারের সম্মুখে দুই প্রস্তর নির্মিত দুটি সিংহ আছে। যার জন্য সিংহদ্বার বলা হয়। আর উপরে মহালক্ষ্মীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এই দ্বার দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করুন। উত্তর দ্বারের দুইপাশে পাথর দিয়ে তৈরি দুটো হাতি আছে। এবং এই দ্বারদেশের উপরিভাগে নবগ্রহের মূর্তি দেখা যায়। পশ্চিম দ্বারের দুপাশে দুটো ছোট-ছোট বাঘ মূর্তি দেখা যায়। আর দক্ষিণ দ্বারে দুটো অশ্ব।
মহাপ্রভু, জগন্নাথ এবং মহালক্ষ্মী একবার কলহ শুরু করেন
তান্ত্রিকরা,পুরীর রাজা এবং রাণি এবং নেপালের রাজা এই দ্বার দিয়ে শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করেন। তাঁরা কিন্তু শুধুমাত্র এই দরজা দিয়েই প্রবেশ করেন। যেটাকে বলা হয় দক্ষিণের দ্বার। শ্রীমন্দিরের দুটো প্রাচীরের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলেন। প্রথম প্রাচীরের নাম তো ‘মেঘনাথ প্রাচীর’। দ্বিতীয়ত প্রাচীরের নাম ‘কূর্মবেঢ়া’ বা ‘কূর্ম প্রাচীর’। মেঘনাথ প্রাচীরের সম্বন্ধে একটা কিংবদন্তী আছে। মহাপ্রভু, জগন্নাথ এবং মহালক্ষ্মী একবার কলহ শুরু করেন। কথাচ্ছলে মহাপ্রভু মহালক্ষ্মীকে গর্জনকারী সাগরের কন্যা হেতু কলহপ্রিয়া বলে দেন। তাতে মহালক্ষ্মী অপমানিত বোধ করে সাগরের গর্জন যাতে মন্দিরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য মেঘনাদ প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছিল। সেইজন্য বাইরের কোনও শব্দ এই প্রাচীর ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। এর গায়ে প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড শব্দরোধক। এও একটা অবিশ্বাস্য স্থাপত্য শিল্প। কূর্মবেঢ়া সামনের প্রবেশ দ্বার। এটা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করার নির্দেশ করে। ভেতর স্থান কচ্ছপ বা কূর্মাকৃতি বলে একে কূর্মপ্রাচীর বা কূর্মবেড়া বলা হয়। মন্দিরে ঢোকার সময় সিংহ দ্বারের সামনে প্রথমে যেটি আমাদের সকলের চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে অরুণস্তম্ভ। এই স্তম্ভটি কালো ক্লোরাইড পাথর দিয়ে তৈরি। ৩৩.৮ ফুট লম্বা। ১৬ টি অংশ আছে। এই স্তম্ভটি যে বেদীর উপর অবস্থিত তার উচ্চতা ভূমি থেকে প্রায় সাড়ে তিন ফুট। অসাধারণ এক কারুকাজ রয়েছে এই স্তম্ভে। স্তম্ভের একদম উপরে সূর্যদেবের বাহন অরুণদেব বিরাজমান। অরুণস্তম্ভের বৈশিষ্ট্য এটাই যে রত্ন সিংহাসনের উচ্চতার সমান। ঐতিহাসিক মত হলো এই স্তম্ভটি ১৮০০ শতাব্দীতে সূর্য মন্দির কোণারক থেকে এনে এখানে স্থাপনা করা হয়েছিল।
বাইশটি সিঁড়ি অতিক্রম করে জগন্নাথের দর্শন করলে জীবনের সব পাপনাশ হয়ে যায়
সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহ ছাড়াও চারদিকে রয়েছে নানা মন্দির। প্রথমত, সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে গেলে বাইশটা সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। সিঁড়ি দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট, প্রস্থ ৬ ফুট,উচ্চতা ৬-৭ ইঞ্চি। কিংবদন্তী হল রাজা ভানুদেব এই সিঁড়ির নির্মাতা ছিলেন। রথযাত্রার সময় মহাপ্রভু জগন্নাথ এই সিঁড়ি দিয়ে রথে আসেন। শাস্ত্র অনুসারে এই বাইশটি সিঁড়ি অতিক্রম করে জগন্নাথের দর্শন করলে জীবনের সব পাপনাশ হয়ে যায়। এই সিঁড়ির উপর পিন্ডদান করেনঅনেকে। তাতে নাকি পিতৃপুরুষ অনেক শান্তি লাভ করেন। এই বাইশ পাহাচ বা সিঁড়ি মানুষকে দোষ দুর্বলতা থেকে মুক্ত করে মোক্ষ প্রদান করে। এখানে অনেকে মানসিক করেন। অনেকে নিজের সন্তানকে এই বাইশটি সিঁড়ির উপর দিয়ে নীচে গড়িয়ে দেন ধাপে ধাপে।
সিংহদ্বার দিয়ে ঢুকতে গেলে উত্তর দিকে পতিতপাবনকে দেখতে পাওয়া যায়। মাদলা পঞ্জিকাতে আছে উড়িষ্যার রাজা রামচন্দ্র দে যবন কন্যার প্রেমে পরে তাকে মন্দিরে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। যেহেতু তিনি যবন কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন আবার খুব জগন্নাথ ভক্ত। তাই মন্দিরের বাইরে থেকেই পতিতপাবনকে দর্শন করে নিজের সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। শ্রীমন্দিরে কেবল হিন্দুদেরই প্রবেশের অনুমতি আছে। অহিন্দুদের বাইরে থেকে পতিতপাবনকে বাইরে থেকে দর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে ফতেমহাবীর,রাধাকৃষ্ণ,হনুমান একহাত মন্দিরে বাইশ হাত ঠাকুর দেখতে পাওয়া যায়। ফলে,এই যে হিন্দু ছাড়া অহিন্দুরা না প্রবেশের যে কাহিনী তার সূত্র কিন্তু রামচন্দ্রদেবের যবন কন্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং বিবাহ। তবে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সময় এসেছে। অহিন্দুদেরও প্রবেশ করতে দেবার অধিকার রাজনৈতিক প্রশাসকদের ভাবা দরকার। মানুষের মধ্যে আরও উদারতা আনার জন্য।
এখানে শুক্লাম্বরধারী সত্যনারায়নকে দর্শন করলেও মোক্ষ লাভ হয়
এবার প্রভু ফিরবেন শ্রীমন্দিরে। সুতরাং চারদিকে এখন সাজসাজ রব। বাইশ পাহাড়ের সিঁড়ি অতিক্রম করার পর দক্ষিণে একটি ছোট্ট মন্দির। এটি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। অনেকে কাশী বিশ্বেশ্বরের মন্দিরও বলে। শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করতে হলে আগে বিশ্বনাথকে দর্শন করাটা বিধি। এই প্রথার মধ্যে দিয়ে বৈষ্ণব এবং শৈব সম্প্রদায়ের সমন্বয়ের আধ্যাত্মিকতা এটি ভারতীয় দর্শনের একটা অভিনব দিক। তারই একটি প্রতীকী রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে আছে শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির। মন্দিরটি উত্তরের অভিমুখে। উচ্চতা পাঁচ ফুট। এখানে শুক্লাম্বরধারী সত্যনারায়নকে দর্শন করলেও মোক্ষ লাভ হয়। সত্যনারায়ণের মূর্তি কষ্টিপাথরে তৈরি। হাতে শাঁখ-চক্র-গদা-পদ্ম শোভিত হচ্ছে। মূর্তির দুপাশ জয়া আর বিজয়া আছেন। নতজানু হয়ে গরুড় দক্ষিণ পায়ের নীচে আছেন। এমন অসাধারণ সুন্দর মূর্তি কিন্তু খুব কম দেখা যায়। কেউ কেউ একে সত্যপীর বলেও অভিহিত করেন। ছেলের মঙ্গল কামনার জন্য সত্যনারায়ণকে দুধ,কলা,আটা আর চিনি দিয়ে সিন্নি ভোগ দেওয়া হয়।
এরপর এসে যায় কল্পবট বৃক্ষ। এই কল্পবট বৃক্ষে তিনটি বটবৃক্ষ চোখে পড়ে। বটগাছগুলোর সঙ্গে কারোর সম্পর্ক নেই। সত্যনারায়ণ মন্দিরের পশ্চিমে যে বটবৃক্ষ সেটা মূল গাছের একটা শাখা মাত্র। কিন্তু দেখলে মনে হবে যে এটি আলাদা গাছ। এই গাছের পশ্চিমে যে বটবৃক্ষ তার নামই হচ্ছে কল্পবট। এর পশ্চিমে আর একটা বটবৃক্ষ আছে। নীলাচলের প্রাচীনতম বস্তুর মধ্যে এই কল্পবট। মহাপ্রলয়ে এই কল্পবট জলে না ডুবে এইভাবেই নাকি দাঁড়িয়ে ছিল। জনার্দন নিজে প্রলয়ের সময় এই বৃক্ষের একটি বটপাতার উপর ভেসে ছিলেন। মার্কেন্ডেয় মুনি কোন আশ্রয় না পেয়ে জনার্দনের নির্দেশে এর উদরে প্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কল্পবটকে নিয়ে কত কাহিনী। কল্পবটে যাওয়ার জন্য চারপাশে রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। মনস্কামনা পূর্ণের জন্য মানুষেরা আসেন কল্পবটের কাছে। কথিত আছে যে এই বটবৃক্ষের নিচে বসে সংকল্প করলে প্রত্যেকের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। তাই এই বৈঠকে কল্পবট বা কল্পতরু বলা হয়। কেউ কেউ একথা বলেন জগন্নাথদেবের আবির্ভাবের আগে বিশ্বাবসু,শবর এই নামে নীলমাধবকে পুজো করতেন। কল্পবটের মূলে একটা ছোট মন্দিরে বটকৃষ্ণ বিরাজমান। বটকৃষ্ণ কালো কষ্টি পাথরে তৈরি। দক্ষিণে মাথা করে একটা ডিম্বাকৃতি পাথরের কুন্ডের ভিতরে বটকৃষ্ণ শয়ন করেন। এই কুন্ডটি ছোট। একটা যেন গাছের পাতা। এরপর আসে বট গণেশ। কল্পবটের নিচে দক্ষিণ দিকে মুখ করে বটগণেশের মন্দির। এই মন্দিরেরও খুব খ্যাতি। এই মন্দিরের অন্য নাম ‘কল্পগণেশ’বা ‘চিন্তামণি’। মূর্তিটি সাদা পাথরের তৈরি। বটগণেশকে দর্শন করে বাঁদিকে এলেন দেখবেন কূর্মবেড়া পার হয়ে দক্ষিণদ্বারের দিকে যান প্রথমে রন্ধনশালার প্রবেশ পথ। তারপরে এসে যাবে শ্রীরামচন্দ্র মন্দির। পাকশালার আগে এই মন্দির। মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্র তার পরিষদবর্গ নিয়ে বসে আছেন। মন্দিরের উপর একটা বিরাট সম্পাতি পাখির উপর অষ্টমল্ল বসে আছে। তারপর ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ মন্দির। শ্রীরামচন্দ্র মন্দিরের একটু আগেই ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ। এই মন্দিরের মধ্যে মহাপ্রভু ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ,প্রভুনিত্যানন্দ,প্রভু অদ্বৈত আছেন। প্রভু গৌরাঙ্গের ষড়ভুজ হলো দুটো ভুজ প্রভুরামচন্দ্রের ধনুস এবং তীর,দুটি ভুজ শ্রীকৃষ্ণের বংশী অবশিষ্ট দুটি ভুজ প্রভু চৈতন্যের দন্ড ও কমুণ্ডল ধারণ করে আছে। ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা এবং পূজাপাঠ প্রমাণ করে যে আজও জগন্নাথদেবের মন্দিরে শ্রীচৈতন্যেদেব কতখানি প্রাসঙ্গিক।
মৎস্যপুরাণে আছে, সর্বমঙ্গলা তন্ত্র সাধনার শ্রেষ্ঠ পীঠ
এরপর আসে বারোভাই হনুমান। ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ মন্দিরের ঠিক পাশেই। বারো ভাই হলেন নর,নীল,সুগ্রীব,কন্দর্প্য,গবাক্ষ,শুষেণ,অঙ্গদ,মহাবীর,মকরধ্বজ,বালি,অঞ্জনা ও হনুমান। বারো ভাই হনুমান শ্রীজগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদকে রক্ষা করে থাকে। এরপর আসবে বটমঙ্গলা বা সর্বমঙ্গলা মন্দির। বুড়িমা মন্দির দেখার পর আবার ভিতরে প্রবেশ করে বটগণেশের পিছনে কল্পবটের নীচেই বটমঙ্গলা মন্দির। মৎস্যপুরাণে আছে, সর্বমঙ্গলা তন্ত্র সাধনার শ্রেষ্ঠ পীঠ। ইনি সর্বপ্রকার মঙ্গল প্রদান করেন। একে তাই বলা হয় সর্বমঙ্গলা। সর্বমঙ্গলা,বিমলা,ভুবনেশ্বরীদেবী সমস্ত শক্তির উৎস।চিন্তমণি গণেশের দ্বারা অনুগৃহীত হওয়ার পর ভক্তগণ শক্তি লাভের জন্য সর্বমঙ্গলাকে প্রার্থনা করে থাকেন। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্দির। এর কাহিনি পৃথকভাবে আলোচনা করার অবকাশ থেকে যাচ্ছে।
অনন্ত বাসুদেব মন্দির
কূর্মপ্রাচীরের দক্ষিণ দ্বারের পশ্চিমে ও মুক্তিমণ্ডপের বাম পাশে অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। এই মন্দির অতি প্রাচীন বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরের মূল মন্দিরটি মুখশালা থেকে ছোট। এই মধ্যে আছে অনন্হ বাসুদেবের এক ছোট মূর্তি। অনস্হ শয্যার বিগ্রহকে অনস্হ বাসুদেব বলা হয়। মন্দিরের মুখ পশ্চিমদিকে।
মুক্তি মণ্ডপ
অনন্হ বাসুদেব মন্দিরের একটু আগে মুক্তিমন্ডপ অবস্হিত। এর অন্য নাম ব্রহ্মাসন বা ব্রহ্মাপীঠ। এই মন্ডলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩৮ ফুট। এর মধ্যে ১৬ টি স্তম্ভ আছে। সেইজন্য এই স্থানে ষোড়শ শাসনের ব্রাহ্মণগণ ও পুরীর শঙ্করাচার্য্য মঠের সন্ন্যাসীগণ শাস্ত্র চর্চা তথা অন্য সামাজিক বিধি বিধান সম্বন্ধে উপদেশ করেন। শ্রীমন্দিরের স্মৃতি বিষয়ক যাবতীয় কার্য্য এখানে নির্ধারিত করার পর শ্রী মন্দিরের প্রচলিত হয়। উড়িষ্যায় স্মৃতি বিষয়ক যাবতীয় ব্যবহার এই সভার দ্বারা মীমাংসিত হয়। এমনকি ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে যে যে স্মৃতি বিষয়ক প্রশ্ন উত্থাপিত তার মীমাংসিত উত্তরও এই স্থান থেকে প্রেরিত হয়। কথিত আছে যে,যখন অনঙ্গ ভীষ্মদেব শ্রী জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করেন, সেই সময় মুক্তিমন্ডপও নির্মিত হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন এই মুক্তিমন্ডপ ভুই বংশের রাজা রামচন্দ্রদেবের সময়ে (১৫৬৮-১৬০৭ খ্রীষ্টাব্দে) মানসিংহের পত্নী গৌরী রাণীর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। কিংবদন্তী আছে শ্রীমন্দির নির্মাণ সময়ে স্বয়ং ব্রহ্মা এখানে উপবেশন করে। শিল্পীদের শ্রীমন্দির তৈরি সম্বন্ধীয় যাবতীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই এই স্হানকে ব্রহ্মাসন বলা হয়। এটি অত্যন্ত পবিত্র ও পূণ্যবান বলে মানা হয়। এই মন্ডপের মাথা টিকে ব্রাহ্মণদের আর্শীবাদ নিয়ে প্রণামী দিলে সর্ব পাপ নাশ হয়।
আদি নৃসিংহ মহাবিষ্ণু মন্দির
মুক্তি মণ্ডপের দক্ষিণদিকে এই মন্দির অবস্থিত। এইটা এক প্রাচীন মন্দির। সর্বপ্রথম এই নৃসিংহ মূর্তি যজ্ঞবেদীতে স্থাপন করে ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ শ্রীব্রহ্মার পৌরিহিত্যে যজ্ঞ করেছিলেন। তাই জন্য একে যজ্ঞ নৃসিংহ বা আদি নৃসিংহ বলা হয়। স্কন্দ পুরাণে বর্ণনা আছে যে নৃসিংহদেব নীলমাধব আবির্ভাব সময়ে বিরাজমান আছে। এই নৃসিংহদেবই মুক্তিমন্ডপের ব্রাহ্মণদের আরাধ্য দেবতা। এই মন্দিরের সবাই পূজনিতি শ্রীমন্দিরের পূজা বিধির মত্ত হয়েছে।
রোহিণী কুণ্ড
জল ক্রীড়া মণ্ডপ পাশে বিমলা মন্দিরের সম্মুখভাগে রোহিণী কুণ্ড অবস্থিত। এই কুন্ডু শ্রীক্ষেত্রের অন্তত পুরাতন স্থানের মধ্যে অন্যতম। এখন এখানে আদিকুন্ড নেই। এখন ভূমির উপর এক ছোট কুন্ডু তৈরি করা হয়েছে এবং এক চতুর্ভুজ কাকের ছোট মূর্তি এবং নীলচক্র নিচে পড়ে থাকা অবস্থায় রাখা হয়েছে। সত্যযুগে এক তৃষ্ণার্ত কাক এই কুণ্ডে পড়ে মোক্ষলাভ করে চতুর্ভুজ হয়েছিল। ব্রহ্মপুরাণের মতে এই কুণ্ডের ভেতরে যাবার জন্যে সিঁড়ি ছিল। কোন কোন পুরাণের মতে দারুর ( যে দারুন চতুদ্ধার্মূর্তির বিগ্রহ নির্মাণ হয়েছিল) আবির্ভাব এইখানেই হয়েছিল। পৌরাণিক মতে শঙ্খাকৃতি ক্ষেত্রের নাভিদেশে এই কুন্ড বিভাজিত। প্রলয়কালে এই কুন্ড থেকে জল বাইরে এসে বৃদ্ধি হয় ও প্রলয় অন্তে বিস্তৃত জলরাশি পুনর্বার এই কুন্ডে লীন হয়ে। তাই এই কুণ্ডের নাম রোহিণী কুন্ড। এই কুণ্ডের জলস্পর্শমাত্র মানবগণের মোক্ষলাভ হয়ে থাকে এবং রোগব্যাধি আদি দূর হয়ে।
বিমলা মন্দির
রোহিনী কুণ্ডের সম্মুখে দেবী বিমলা মন্দির অবস্থিত। এইটি অতি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের উচ্চতা ৪৫ ফুট। মৎস্য পুরাণে এবং স্কন্দপুরাণে দেবী বিমলাকে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের প্রধান দেবী পীঠ ভাবে বর্ণনা হয়েছে। তন্ত্র চূড়ামণিতে উল্লেখ আছে যে এইস্থানে সতীর নাভি পড়েছিল এবং বিমলাকে ভৈরবী ও জগন্নাথকে ভৈরবরূপে মধ্যে উল্লেখ আছে। বিমলা মন্দিরের জগমোহন দশ মহাবিদ্যা,গণেশ,কার্তিক ও ছায়ামায়ার আদি বিগ্রহ বিদ্যমান। এতদ্ব্যতীত জগমোহনে এক ভয়ঙ্করী মূর্তিও আছে। একে কেউ কেউ ভগদর্শনী বলে থাকেন। এই মূর্তিকে অশ্লীল বললেও এর যথেষ্ট মহত্ত্ব আছে। বিমলাদেবীর সবচেয়ে বড় মহত্ত্ব যে জগন্নাথদেবের কাছে অন্নভোগ সমর্পণ করার পর সিমলার কাছে সমর্পণ করা হলে অন্নভোগ মহা প্রসাদ হতে পারে। আশ্বিন মাসে বিমলা দেবীর ষোড়শ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
সাক্ষীগোপাল মন্দির
শ্রীমন্দিরের নক্সা পাশেই আছে সাক্ষীগোপাল মন্দির। এই মন্দিরে কৃষ্ণ ও রাধার বিগ্রহ পূজিত হয়। কথিত আছে যে পুরুষোত্তম দেব জগন্নাথ বলভদ্রের সহায়তায় কাঞ্চী রাজাকে পরাজিত করে ফেরার সময় সাক্ষীগোপালকে সঙ্গে নিয়ে এসে এই মন্দিরে প্রথমে স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই সাক্ষীগোপাল পুরী থেকে ১৮ কিমি দূরে সাক্ষীগোপাল নামক স্থানে স্থানান্তরিত হয়ে পূজিত হচ্ছেন।
একাদশী মন্দির
সাক্ষীগোপাল মন্দিরের সম্মুখে শ্রীমন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালের নীচে একটি ক্ষুদ্র মন্দির অবস্থিত,এটিকে একাদশী মন্দির বলা হয়। এখানে একাদশী দেবী পূজো হয়েছে। কথিত আছে, শ্রীজগন্নাথ একাদশী দেবীকে এখানে বেঁধে রেখেছেন। তাই শ্রীক্ষেত্রে নিরাহার থেকে একাদশী পালন করা অনুচিত। মহাপ্রসাদ সেবন করে ব্রত পালন করা হয়।
কাঞ্চি গণেশ মন্দির
এই মন্দির সাক্ষীগোপাল মন্দিরের পাশেই অবস্থিত। কেউ কেউ একে ভন্ড গণেশ বা কামদ গণেশও বলে থাকেন। কামদ গণেশ বলা হয় বলে একে জগন্নাথদেবের পেছনে স্থাপনা করা হয়েছে। এই মূর্তির নির্মাণশৈলী কর্ণাটক নির্মাণশৈলীর সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ। কথিত আছে যে ইনি গণেশকে কাঞ্চি রাজা তাত্বিক পদ্ধতি রূপে পূজো করেছিল। কাঁচী যুদ্ধের সময়ে ইনি গণেশ শক্তিকে কোলে বসে নিজের যোনীর থেকে অসংখ্য গণেশ সৃষ্টি করেছিল। কাঁচী বিজয় পর রাজা পুরুষোত্তমদেব কাঁচী থেকে নিয়ে এসে শ্রীমন্দিরে স্থাপনা করেছিল,তাই জন্য একে কাঁচী গণেশ বলা হয়।
চারধাম মন্দির
কাঞ্চি গণেশ দর্শন করে বাঁ-এ দক্ষিণ দ্বারের কূর্মবেড়া পার হলে সম্মুখে চারধাম মন্দির দেখতে পায়। ভারতের প্রসিদ্ধ চারটি পবিত্র ধামের দেবতারা এই মন্দিরে স্থাপিত হয়েছেন। এই মন্দিরে শ্রীজগন্নাথ,শ্রীবদ্রিনারায়ণ,শ্রীদ্বারকাধীশ ও শ্রীরামেশ্বর চারটি প্রসিদ্ধ ক্ষেত্রর দেবতারা বিদ্যমান। যারা ভারতের চারধাম ভ্রমণ দর্শন করতে না পারে,এই চারধামকে দর্শন করেন তারা চতুর্ধাম দর্শনের ফল লাভ করে থাকেন। এই চাতুর্ধামের রক্ষক বীর হনুমান এই মন্দিরের পশ্চিমদ্বারে বিরাজমান।
কানপাতা হনুমান
পশ্চিমদ্বারের নিকটে এক বিরাট হনুমানের মূর্তি আছে। একে কানপাতা হনুমান বলা হয়। শ্রীমন্দিরে সমুদ্র গর্জন প্রবেশ করে যাতে শ্রীজগন্নাথের বিশ্রাম-সুখভঙ্গ করতে না পারে এজন্য ইনি সর্বদা কান পেতে আছেন। তাই এখন আর মন্দিরের মধ্যে গর্জন শোনা যায় না।
নীলাদ্রি বিহার
পশ্চিমদ্বারের উত্তর পার্শ্বে কানপাতা হনুমান মন্দিরের পেছনে এটি অবস্থিত। শ্রীজগন্নাথ মন্দির তথা জগন্নাথ ধামের যাবতীয় গবেষণা ও অধ্যায়নের জন্য এক প্রদর্শনী করা হয়েছে। এর নাম নীলাদ্রি বিহার।
নীলাচল উপবন বা অলকা বাটিকা
চারধাম মন্দিরের কাছে এই উপবন আছে। বিগ্রহদের ফুল আর তুলসী পাতার প্রয়োজন মেটানোর জন্য শ্রীমন্দিরে এই উপবনের উদ্দেশ্য। এটি এক সুন্দর দর্শনীয় স্থান। এই উপবনের মধ্যে নবগুঞ্জর, রাধাকৃষ্ণ,পঞ্চমূখী মহাদেব, চক্রনারায়ণ ও সিদ্ধেশ্বর মূর্তি দৃষ্টিগোচর হয়। এই অলকা বাটিকা দিয়ে এগিয়ে গেলে মেঘনাদ প্রাচীরের উপর দক্ষিণ পশ্চিম কোণে দূর্গামাধবের মন্দির দেখা যায়।
ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির
নীলাদ্রি বিহার দেখে আবার ভেতরে বেড়া প্রবেশ করলে, কাঁচী গণেশের অপর পাশে ক্ষীরচোরা গোপিনাথের মন্দির বিদ্যমান। মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণর যুগল মূর্তি পূজা পাচ্ছে। এই ক্ষীরচোরা মন্দির বানেশ্বর শহরের রেমুনা নামক স্থানে অবস্থিত। এই স্থান কলকাতা থেকে ২৫০ কিমি। রেমুনাতে ক্ষীরচোরার মূর্তি এবং পুরীতে ক্ষীরচোরার মূর্তি প্রায় এক রকম। মাধবানন্দ নামে এক পরম ভক্তের জন্য উনি ক্ষীরচুরি করেছিলেন বলে ওনার নাম ক্ষীরচোরা গোপীনাথ।
ভুবনেশ্বরী মন্দির
ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দিরের কাছে ভুবনেশ্বরী বা পঞ্চশক্তির মন্দির। শক্তি পূজার ক্রমান্বয়ে ৫টি আদি মাতৃকাকে এখানে উপাসনা করা হয়। এঁরা হলেন সরস্বতী, গায়ত্রী, ষষ্ঠী ও ভুবনেশ্বরী। এঁদের পঞ্চলোক মাতৃকাও বলা হয়। এখানে নৃসিংহ ও পূজিত হন। এই মন্দিরের দেওয়ালে জগন্নাথদেবের এক চিত্র আছে।
নীলমাধব মন্দির
ভুবনেশ্বরী মন্দিরের উত্তর পাশে নীলমাধব মন্দির আছে। একখানি কষ্টিপাথরে এই মূর্তি নির্মিত। এই মূর্তির কারুকার্য অত্যন্ত সুন্দর। নীলমাধব এক সিংহাসনের ওপর উপবেশন করে আছেন ও বামপার্শ্বের একটু দূরে জগন্নাথের এক ছোট মূর্তি আছে ও দক্ষিণ পার্শ্বে শ্রীকৃষ্ণের এক মূর্তি আছে। পৌরাণিক মত্ত যে রাজা গালমাধব এই নীলমাধবকে শ্রীমন্দিরে পূজা করতেন মাত্র চতুর্দ্ধামূর্তির স্থাপনার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এখানে নিয়ে এসে পূজোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
ভদ্রকালীর বা বেড়াকালী মন্দির
নীলমাধব মন্দিরের পাশে একটি ভেতরে ভদ্রকালী বা বেঢ়াকালী মন্দির অবস্থিত। উনি হলেন জগন্নাথ মন্দিরের রক্ষক। এই কালী দেখতে খুব ভয়ঙ্করী। এখন যে মূর্তি আছে তা প্রকৃত কালী নয়। প্রকৃত কালী মূর্তি এখনকার কালী মূর্তির পেছনে গোপন রাখা আছে। এর কারণস্বরূপবলা হয় যে, প্রকৃত কালীর এত প্রতাপ ছিল যার জন্য অতীতেএই পথ দিয়ে কেউ যাতায়াত করতে পারত না। তাই মরহট্টা রাজত্বে বালক ব্রহ্মচারীর তত্ত্বাবধানে উক্ত কালী মন্দিরটি বন্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই কালী মূর্তি স্থাপনা করা হয়। এই মূর্তির ডান হাতের পাশে এক রন্দ্র আছে। এই রন্দ্র দিয়ে ফুল চন্দন প্রবেশ করিয়ে দেবীকে অর্চনা করা হয়। এই মূর্তি দ্বিভুজা। ডান হাতে গন্ডা ও বাম হাতে মুন্ডমালা। উচ্চতা প্রায় ৩ ফুট। এই মন্দিরের কাছে আর একটি লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির আছে। মন্দিরে লক্ষ্মী নারায়ণ পূজিত হন।
মহালক্ষ্মী মন্দির
ভদ্রকালীমন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে এবং ভেতর বেড়ার বায়ু কোণে লক্ষ্মী ঠাকুরাণীর মন্দির অবস্থিত। এটি এক প্রাচীন মন্দির। ঐতিহাসিক মত অনুসারে এই মন্দির উড়িষ্যার গঙ্গা বংশীয় রাজা চোড়গঙ্গা দেবর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। কষ্টিপাথরে নির্মিত মহালক্ষ্মী মূর্তি চতুর্ভুজা। উপর দুই হাতে হস্তি ধারণ করে আছে, নিচে দুই হাত বরদ তথা অভয় মুদ্রারূপে আছে । এখানে পন্ডিতগণ বসে বৈষ্ণব ধর্ম সম্বন্ধীয় আলোচনা, প্রবচন ও পুরাণ পাঠ আদি হয়ে থাকে। সেইজন্য মহালক্ষ্মীকে দর্শন করে অচিন্তা মন্ডপে কিছুক্ষণ বসলে সকল চিন্তা দূর হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই পীঠে আদি শঙ্করাচার্য্য যিনি লক্ষ্মী-নৃসিংহ মূর্তি পূজো করেছিলেন,সেই মূর্তি এখন জগমোহনে আছে। দেবীকে প্রত্যহ খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়।
নবগ্রহ মন্দির
মহালক্ষ্মী মন্দিরে জগমোহনের উত্তর দিকে নবগ্রহ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরের মধ্যে রবি,চন্দ্র, মঙ্গল,বুধ,বৃহস্পতি,শুক্র,শনি,রাহু ও কেতু পূজিত হন। নবগ্রহকে বাদ দিয়ে সমলেশ্বরী,রাম,লক্ষণ,সীতাও হনুমানের মূর্তি আছে।গ্রহরিষ্ট শান্তির জন্য এখানে পূজা করা হয়।
কোণার্কের সূর্য নারায়ণ মন্দির
নবগ্রহ এবং লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির দেখার পর একটু আগে গেলে সূর্য মন্দির অবস্থিত। এইটি এক প্রাচীন মন্দির। মাদলা পঞ্জিতে উল্লেখ আছে যে মুসলিম রাজা কালাপাহাড়ের দ্বারা ভেঙ্গে যাবার পর রাজা নরসিংহ দেব(১৬২২-১৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে) মূর্তিগুলো কোণার্ক থেকে এনে এখানে স্থাপনা করেছিলেন। মূল মন্দির, জগমোহন ও নাটক মন্দিরকে নিয়ে এই মন্দির নির্মিত হয়েছে। মূল মন্দিরের ভেতরে কালো মু্র্গুনী পাথরের নির্মিত সপ্তাশ্বসজ্জিত সূর্য নারায়ণের মূর্তি বিরাজমান। একে আদি সূর্য,আদি নারায়ণ,রবি নারায়ণ এবং ধর্ম নারায়ণ মধ্যেও বলা হয়।এই মূর্তির পিছনে অতি সুন্দর একটি ভগ্ন মূর্তি সিংহাসনের ওপর বসে আছেন। ওনাকে পূজো করা হয়না। কেউ কেউ এই মূর্তিকে ইন্দ্র মূর্তি বলেন। সূর্যনারায়ণের সম্মুখে জগমোহনের অষ্টধাতুর দুটি মূর্তি আছে। একটি বড় আর একটি ছোট। বাড়ি দক্ষিণায়ন সূর্য এবং ছোটটি উত্তরায়ণ সূর্য রূপে পূজিত। কেউ কেউ উত্তরায়ণকে চন্দ্র বলে থাকেন। এই দুটি মূর্তির পায়ে জুতো মুজো পরে আছেন। কারণ সূর্য হল ৯ গ্রহের রাজা।
প্রতিবর্ষ আগে সূর্যের রথযাত্রা চৈত্র শুক্লা ষষ্ঠীতে অনুষ্ঠিত হয়,একে চৈত্র গুন্ডিচা বলা হয়। কিন্তু আষাঢ় মাসে শ্রীজগন্নাথের রথযাত্রা পালিত হয়। এইদিন রথে সূর্যদেবের প্রতিমা দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণ বসে শ্রীমন্দিরের বাইর বেড়াতে ঘুরে জগমোহন গমন করে। এছাড়া সাম্বদশমী,মাঘসপ্তমী এবং সপ্তপুরী অমাবস্যা প্রভৃতি উৎসব এখানে পালন করা হয়। এই সূর্য মন্দিরের স্বতন্ত্র রন্ধনশালা আছে। এই মন্দিরের দরজার পাশে জুড়ে ঠাকুর আছেন। বিভিন্ন জ্বরের সময় একে দুধ, চিনি কলা আদি পূজো দিলে জ্বর ভাল হয়ে থাকে বলে বিশ্বাস।
শ্রীপাতালেশ্বর মহাদেব মন্দির
কূর্ম প্রাচীরের উত্তরদ্বারের পশ্চিম ভাগে পাতালেশ্বর মহাদেবের মন্দির অবস্থিত। কূর্মবেড়ার ভূমি থেকে প্রায় ২০ ফুট নিচে শিবলিঙ্গ রয়েছে। লিঙ্গের পাশে যেতে হলে ধাপ পেরিয়ে ভেতরে যেতে হয়। বাইরে থেকে মন্দিরটি অর্ধেক পুঁতে থাকার মতো বল মনে হয়। শ্রীমন্দির তৈরির যথেষ্ট আগে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। এই মন্দিরের দরজায় গঙ্গবংশীয় রাজা অনঙ্গভীম দেবের সময়ের তিনটি শিলালেখ আছে।
পাদপদ্ম
পাতালেশ্বর মন্দিরের সম্মুখে উত্তর দরজার পূর্বদিকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পাদপদ্ম আছে, এখানে দাঁড়িয়ে নীলচক্র দর্শন করার বিধি আছে। এটি। প্রথমে শ্রীমন্দিরের গর্ভ স্তম্ভের পাশে ছিল। পরে গৌড়িয় বৈষ্ণব ভক্তগণের দ্বারা এটিকে এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। চৈতন্য পাদপদ্মের পাশে নারায়ণ মন্দির আছে। এই মন্দিরে শ্রীজগন্নাথদেবের ফুলমালা গুন্হা হয়।
শ্রীমন্দির কার্যালয়
পাদপদ্ম পাশে শ্রীমন্দিরের কার্য্যালয় আছে। এই কার্য্যালয়ে দান দক্ষিণা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভোগের ব্যবস্থা করা হয়।
শ্রীচৈতন্যদেব মন্দির
শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করার সামনে এখানে কীর্তন শুরু করেছিলেন ও এখানে মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব সঙ্গে সৎসঙ্গ করতেন। সেই স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে এই মন্দির শ্রীচৈতন্যদেবের প্রতিমূর্তি রাখা হয়েছে।
গারদ
জগমোহনের বামপার্শ্বদ্বারে শ্রীমন্দিরের গারদ অবস্হিত। এইটা এক শাখা কার্যালয়। প্রধান কার্যালয় পুরীরাজ প্রাসাদ সম্মুখের বড় রাস্তায় অবস্হিত। এখানে শ্রীজগন্নাথদেবের দৈন-দিনের নীতি শ্রীমন্দিরের আদেশ কর্তা ও কর্মচারীগণ কার্যনির্বাহ করে থাকেন। যাত্রীগণ বিভিন্ন অসুবিধার জন্য এখানে যোগাযোগ করতে পারেন। এই কার্য্যালয় থেকে মন্দির সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়।