জগন্নাথদেব চলেছেন। আজও তাঁর যাত্রাপথে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ। সরকারি হিসাব বলছে, এবার পুরীতে রথযাত্রায় অংশ নিতে এসেছেন দশ লক্ষ মানুষ। যত দেখছি, অবাক হয়ে যাচ্ছি। জগন্নাথ দেবের রথ, তাঁর সঙ্গে দাদা আর বোনের রথ চলেছে। প্রথমে চলেছেন দাদা আর মাঝখানে বোন। সবশেষে জগন্নাথদেব। কত রকমের সেবক! কত রকমের দায়িত্ব বণ্টন!
প্রত্যেকটি বিষয় অনেক বছর ধরে সুপরিকল্পিত এবং সমস্ত কিছু শৃঙ্খলাবদ্ধ। জগন্নাথদেবের রথের নাম, নন্দীঘোষ। বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ। আর সুভদ্রার রথের দেবদলনী। নন্দঘোষ, মানে জগন্নাথদেবের রথ নির্মাণ করতে ৮৩২টি ছোট-বড় কাঠের টুকরো লাগে। রথের উচ্চতা ১৩.০৫ মিটার। আগে জগন্নাথের রথে মোট আঠেরোটি চাকা ছিল। হিন্দু ধর্মের অষ্টাদশ সিদ্ধির পরিচয় স্বরূপ এই ১৮টি চাকা। পরে ১৬টি চাকা হয়। নন্দী ঘোষ রথটির চূড়োয় যে ধ্বজা, তার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী। আর এই রথের দু’জন দ্বারপাল, ব্রহ্মা ও ঐক্য। নন্দী ঘোষে কিন্তু শুধু জগন্নাথ দেব নন, পার্শ্ব দেবতা ন’জন, তাঁদেরও মূর্তি আছে। বরাহ, গোবর্ধন, কৃষ্ণ, নৃসিংহদেব, রাম, নারায়ণ, তৃবিক্রম, হনুমান ও রুদ্র।
প্রতিটি রথের কাঠের কাঠামো নানা রঙের কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জগন্নাথ দেবের রথের কাপড় লাল-হলুদ। তবে এই হলুদ অনেকটা সোনার রঙের। রথের চারটি ঘোড়ার নাম শঙ্খ, বলাতক, শ্বেত ও হরিদ্বাক্ষ। এই রথে সুদর্শন চক্রের পাশে কোনও পাখি নেই। এই রথ চলেছে জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচার মন্দির। এই পথটুকু পাড়ি দিতেই সারাদিন লেগে গেল। অগণিত ভক্ত রথের রশি ধরে টান দিচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে রথগুলো অতি ধীর গতিতে এগোচ্ছে। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ কিন্তু সমস্ত রীতি মেনে হচ্ছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পুরীর এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে একটা বিশেষ অসুবিধে ছিল। ওই সময় জগন্নাথ মন্দির ও গুন্ডিচা মন্দিরের মাঝে মালিনী নামে একটা নদী ছিল। জগন্নাথ মন্দির থেকে রথযাত্রা শুরু হল। সেই রথ এসে থামত মালিনী নদীর পাড়ে। তারপর সেখানে নৌকো প্রস্তুত থাকত। সেই সেই তিনটি বিগ্রহকে তিনটি নৌকোয় তুলে ওপারে আনা হত। সেখানে আবার রথ দাঁড়িয়ে থাকত। নদীর ওপাড় থেকে সেই রথ যেত গুন্ডিচা মন্দিরে। উল্টো রথে ঠিক এভাবেই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা ফিরে আসতেন শ্রীমন্দিরে।
পুরীর রথযাত্রা কীভাবে শুরু হয়, সেটা নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবে অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন, বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। ঐতিহাসিক রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেছেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই বুদ্ধদেবের মূর্তি রথে চড়িয়ে সেই রথ টেনে নিয়ে যেত। ফা-হিয়েন পর্যন্ত এই রথাযাত্রা চাক্ষুষ করেছেন। তিনি দেখেছেন, রথে বৌদ্ধমূর্তি বসানোর আগে ভুটানের রাজা সেই রথে জল ছিটিয়ে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেছেন। পশ্চিম চিনে এইরকম রথযাত্রা হত। বুদ্ধদেবের পাটলিপুত্রেও রথযাত্রার উৎসব দেখেছিলেন ফা-হিয়েন। পুরীর সমুদ্রের তীরে রথযাত্রা উৎসব হত। মুরারী মিশ্রের ‘অনহর্গ রাঘব’ নাটকে এরকম তথ্য পাওয়া গেছে।
রথ এগোতে এগোতে কুমোরপাড়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। এই কুমোরপাড়া নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনি আছে। এখানে কুমোরপাড়ার এক কুমোর গিন্নি, তার নাম নিধি। তাকে কোনও পুজারী এসে প্রশ্ন করেছিল, তুমি রথ দেখতে যাবে না? এরপর তাকে সেই পুজারী বললেন, তুমি মন্দিরে যাবে, না রথের রশি ধরতে যাবে? সেই নিধি বলল, আমার তৈরি করা মাটির তৈরি কলস ও বাসনপত্র জগন্নাথ দেবের কাছে পৌঁছে যায়। জগন্নাথের কাছে তারাই যেতে পারে। আমি আর কী করে যাব! জগন্নাথ দেবের কানে সে কথা যায়। তিনি নাকি বলেন, রথযাত্রার সময় যখন আমি দেখতে বেরবো চারদিক, তখন ওই ওই নিধির কাছে কুমোরপাড়ায় আমি থামব।
জগন্নাথ যখন রথযাত্রায় আসেন, তখন মূল যে মন্দির, সেই মন্দিরে মাধব ও শ্রীদেব থাকেন। মাধব তখন দেখাশোনা করার জন্য থেকে যান। যেরকম আমাদের ঘর সংসারে হয় যে, বাড়ির প্রধান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে অন্য কেউ দায়িত্ব নিয়ে দেখাশোনা করেন। এখানেও সেরকম একটা ব্যবস্থা আছে। সুদর্শন চক্রকেও কিন্তু জগন্নাথ দেবের সঙ্গে প্রদক্ষিণ করানো হয়। কথিত আছে, মন্দিরে জগন্নাথের ঐশ্বর্যলীলা। আর রথযাত্রা করে তিনি মাসীর বাড়ি যান, তখন সেই ন’দিন তাঁর রথযাত্রায় হয় মাধুর্যলীলা। এই ঐশ্বর্যলীলা ত্যাগ করে মাধুর্যলীলায় আসায় মা লক্ষ্মী তাঁকে অভিমান করে যে, তুমি তাহলে মাসীর বাড়িতেই থাকো। তোমাকে আর আসতে হবে না। সেই জন্যে রাগ করে তিনি রথের একটা পায়া ভেঙে দেন। আজও প্রথা আছে যে, রথ পৌঁছলে রথের চাকার একটা কাঠের টুকরো ভেঙে দিতে হয়।
তবে এত খুশির আবহে দুঃখের কথা একটাই য়ে, মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। সেটা পুলিসি প্রশাসনের ব্যর্থতা নিশ্চয়ই। রথযাত্রার প্রথম দিনে পদপিষ্ট হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে জগন্নাথ দেবের সামনে। শতাধিক মানুষের আহত হয়ে যাওয়া, এ তো আনন্দের কথা নয়। বিশেষত ক’দিন আগেই পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। তা থেকেও উড়িষ্যা সরকার শিক্ষা নিতে পারতেন। এই দুঃখ এই জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার মধ্যে একটা বেদনার আবহও তৈরি করে। তবু রথ এগোচ্ছে। প্রভু জগন্নাথ চারদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। দু’ধারে মানুষ দাড়িয়ে রয়েছে। ধ্বনি উঠছে বারবার— জয় জগন্নাথ! জয় জগন্নাথ!
তথ্যসূত্র:- (সুমন গুপ্তর শ্রী জগন্নাথ দেবের অমৃত কথা)।
চলবে...