সাধারণ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সমস্ত ছবি বা প্রতিকৃতি আমরা এক রকমই দেখতে পাই। কখনও ভেবে দেখেছেন এর কারণ কী? এর কারণ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি দুর্লভ ছবি থেকেই এ সমস্ত ছবি এবং মূর্তি গড়া হয়েছে। তৎকালীন ভাওয়াল রাজের তোলা একটি ছোট ছবি থেকে। ছবির মাপ ছিল ৩ ইঞ্চি বাই ৫ ইঞ্চি। এই ছবিটি থেকে একটি বড় মাপের অয়েল পেন্ট করানোর কথা ভাবেন ঢাকার বিখ্যাত নাগ পরিবারের বধূ বেণুকা দেবী। তিনি ছিলেন প্রেমরঞ্জন নাগের স্ত্রী।
ঢাকার প্রতিভাবান এক শিল্পী দুর্গেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-কে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই ছবি আঁকার বরাত দেন। আঁকার সময় থেকেই শুরু হয় অতিলৌকিক কিছু ব্যাপার। দুর্গেশবাবু প্রথমে A4 মাপের একটি কাগজে প্রতিকৃতিটি আঁকতে শুরু করেন। সাদা কাগজে তিনি প্রাথমিক স্কেচ করেন। আসল প্রতিকৃতিটি তাঁর সামনে দেওয়ালে টাঙানো ছিল। স্কেচ খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎই এমন কিছু অনুভব করেন দুর্গেশ যার ব্যাখ্যা তিনি আজীবন করতে পারেননি। তিনি জানিয়েছিলেন, আঁকার সময় যেন তাঁর দেহে এক তরিৎ প্রবাহ চলছিল। খানিক বাদে তিনি প্রায় বেহুঁশ হয়ে যান। কী ভাবে আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে তার সঠিক ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি।
আবিষ্ট অবস্থায় দুর্গেশবাবুর হাত অবিশ্বাস্য গতিতে চলতে থাকে। একটি A4 কাগজে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মুখ আঁকা হয়। তাঁর শরীরের বাকি অংশ অন্য কয়েকটি কাগজে এঁকে একত্র করে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করা হবে ঠিক হয়। সব শেষে দুর্গেশবাবু প্রতিকৃতির চোখ আঁকবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু চোখ আঁকতে গিয়ে বার বার বিপত্তি দেখা দেয়। চোখ আঁকতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন, যে আবেশে তিনি পুরো ছবিটি এঁকেছেন, তা লুপ্ত হয়েছে। কিছুতেই তিনি প্রতিকৃতিতে প্রকৃত চক্ষুদান করে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের মতো করে প্রতিকৃতির চোখ আঁকেন।
নাগ পরিবারের এক প্রবীণ সদস্যকে নিয়ে এসে সেই প্রতিকৃতি দেখানো হয়। তিনি জানান, ছোটবেলায় তিনি বাবা লোকনাথকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি দুর্গেশবাবুর আঁকা প্রতিকৃতির চোখের সঙ্গে বাবা লোকনাথের চোখের কোনও মিল নেই বলেন। বার বার দুর্গেশবাবু চোখ আঁকেন, বার বার সেই প্রবীণ ভদ্রলোকও হচ্ছে না বলে জানান দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত অবস্থায় সেই ছবি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পড়ে থাকে।
রায় দেড় বছর পরে এক শীতের সন্ধ্যায় দুর্গেশবাবু ঢাকায় বুড়িগঙ্গার ধারে একটি পার্কে হাঁটছিলেন। পার্কের দরজা দিয়ে বেরতে গিয়ে তিনি টের পান সেটি বন্ধ এবং সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছেন বলে মনে হয় তাঁর। মুখ তুলে তিনি দেখতে পান, এক দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। একটি আচ্ছাদনে তাঁর মুখটি ঢাকা। দুর্গেশবাবু দেখতে পান, অতি তীব্র আলোকজ্যোতিসম্পন্ন চক্ষুদ্বয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং লোকনাথ। দুর্গেশবাবু জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরতেই তিনি কাউকে আর দেখতে পাননি। তড়িঘড়ি রেণুকাদেবীর বাড়িতে যান দুর্গেশ এবং দ্রুত হাতে প্রতিকৃতিতে চক্ষুদান করেন।
পরের দিন সেই প্রবীণ ভদ্রেলোককে নিয়ে আসা হয়, যিনি চোখ দেখে বলেছিলেন লোকনাথের চোখের সঙ্গে কোনও মিল নেই। তিনি প্রথম দর্শনেই চমকিত হন। ‘বাবা’ বলে উচ্চৈস্বরে ডেকে তিনি জ্ঞান হারান। রেণুকাদেবীর দৌহিত্র অভিজিৎ রুদ্র বর্তমানে কলকাতার সল্টলেকের বাসিন্দা। আজও এই ছবি পূজিত হয় তাঁর বাড়িতে।