কোনও ঢাকের বাদ্যি নেই, নেই কোনও মন্ত্রোচ্চারণ। নেই আলোকমালায় সেজে ওঠা মণ্ডপ, প্যান্ডেল। কিন্তু চুপিসাড়ে আরও একটি দুর্গাপুজো দিন ক্ষণ মেনে ঘটে চলছে, তা বোধহয় কেউ লক্ষ্য করছেন না। দুর্গা পূজা এবং বাঙালি এই দুটি শব্দ এখন একই কয়েনের দুটি পিঠের মতো। একটির সঙ্গে অন্যটির আইডেনটিটি জড়িয়ে রয়েছে। একটি ম্লান হলেই বোধহয় পরিচয়হীনতায় ভুগবে একটা গোটা জাত। কিন্তু সেটা বললে অর্ধেক বলা হবে। দুর্গা পূজা মানে শারদীয়া দুর্গোৎসব। হ্যাঁ, আপামর বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো বললে শরৎ কালের শিউলির গন্ধমাখা পরিবেশে নতুন করে সেজে ওঠা। এক সময় বাঙালির কাছে দুর্গা পূজা মানে বাসন্তী পূজাই বোঝাত। তা হলে বাসন্তী পুজো ব্যাক সিট নিয়ে নেওয়ার কারণ কী? কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্বের অবতারণা হল।
প্রথমটি অবশ্যই ধর্মীয় একটা কারণ। শিক্ষক এবং গবেষক কিঞ্জল বসু জানাচ্ছেন, পুজোর কনসেপ্ট থাকলেও সেটা কিন্তু বারোয়ারি কখনই ছিল না। বাসন্তী পুজো মূলত হত গ্রামের জমিদার বাড়ি কেন্দ্র করেই। তিনি বলেন, 'আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, বাসন্তী পুজো এখন শুধুমাত্র কয়েকটি বনেদি বাড়ি এবং প্রাচীন জমিদার বাড়িতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছে। অতীতেও কিন্তু এর অন্যথা ছিল না। হ্যাঁ, এটা বলতে পারেন, সংখ্যায় হয়তো বেশি হত, কিন্তু তা কখনও উৎসবে পরিণত হয়নি। আমার মতে এর মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কাহিনি বাঙালির কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণটি অবশ্য রাজা সুরথের জন্য।'
এখানে একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। পুরাণে দুটি কালে বছরকে ভাগ করা হয়েছে। উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ। পুরাণ অনুযায়ী উত্তরায়ণে (অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে) দেবদেবীরা জেগেই থাকন। আর দক্ষিণায়ণের (অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে) সময় হল তাঁদের নিদ্রার সময়। দক্ষিণায়ণের এই ছ’ মাস হল- শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ। এ সময় তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই তাঁদের জাগানোর জন্য বোধনের প্রয়োজন হয়। তাই একটা দীর্ঘ সময় কোনও পুজো অর্চণার সুযোগ ছিল না। কিঞ্জল বলেন, 'রাজা সুরথ এই সময় তাঁর পুরোহিতদের ডেকে বলেন, পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে এ সময়ে কোনও পুজা করা যায় কিনা তা দেখতে। সে সময় এক পুরোহিত তাঁকে বলেন, রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কথা। সেই থেকে পুজোর চল বলে অনেকে মনে করেন।'
প্রাচীন কলকাতা এবং বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করা প্রবীণ সাংবাদিক গৌতম বসু মল্লিক অবশ্য এর সঙ্গে একটি আর্থ সামাজিক কারণও দেখেন। তিনি বলেন, 'মানুষের হাতে টাকা থাকলে তবেই উৎসবে সামিল হতে পারেন। এটা একেবারে সোজা হিসাব। তোমার হাতে যদি টাকা না থাকে সে ক্ষেত্রে তুমি ভালো জামাকাপড় পরতে পারবে না, ভালো খাওয়া-দাওয়া করতে পারবে না। শরৎ কালে বর্ষার শেষে ফসল বিক্রি করে কিছু টাকা থাকত তখন সাধারণ মানুষের হাতে। তাই উৎসবে সামিল হওয়া যেত। দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই কৃত্তিবাস ওঝা। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামের অকাল বোধনের একটা সবিস্তারে বর্ণনা রয়েছে। দীর্ঘ বর্ণনা বাঙালিকে রীতিমতো পূজোর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। বাল্মিকী রচিত রামায়ণে কিন্তু এত দীর্ঘ এবং সুস্পষ্ট আলোচনা করা নেই। ফলে মধ্য যুগের পর থেকে বাঙালির অকাল বোধনের চল লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে জমিদার বাড়ি কেন্দ্রিক হলেও, পরে তা বারোয়ারিতে রূপান্তরিত হয়েছে।'
বাসন্তী পুজো অবশ্য এখন কয়েকটি ছোট পুজোতেও ভাগ হয়ে গিয়েছে। যেমন অন্নপূর্ণা পুজো। বাসন্তী পুজোরই অঙ্গ। কিন্তু এই পুজো এখন অনেক বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে নিয়ম মেনে ৫ দিনের পুজোর ধকল অনেকেই নিতে পারেন না। এর সঙ্গে সময়েরও একটি সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। আগে বসন্ত কালে বহু গ্রাম বসন্ত রোগে উজাড় হয়ে যেত। এ সময় তাপমাত্রাও থাকে এক অসহনীয় মাত্রায়। তুলনায় শরৎ কাল অনেক বেশি মোলায়েম। সব মিলিয়ে উৎসবের জন্য আদর্শ সময়। আৎ দুর্গা পুজো শুধুমাত্র যে পুজো নয়, উৎসবে পরিণত হয়েছে তা কে না জানে।