বাঙালির প্রিয়তম মাছ কী? ভাবার অবকাশ নেই। সঠিক উত্তরের জন্য কোনও পুরষ্কারও নেই। যে কেউ আনমনেও বলে দেবে মাছের রাজা ইলিশ ছাড়া আর কিছু নয়। আর হতেও পারে না। গঙ্গা হোক কী পদ্মা, চাঁদপুর হোক কিংবা দিঘা,বর্ষায় ইলিশ পাতে চাইই চাই। ইলিশ আমাদের লাইফস্টাইলের একটা ফ্যান্টাসি। পাতে গরমাগরম ইলিশ এনে ফেলতে পারলে যেমন পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে আলাদা কেত নেওয়া যায়, তেমনই একটা প্রমাণ সাইজের ইলিশ হেঁশেলে ঢুকিয়ে দিতে পারলে আম বাঙালি কর্তার, গিন্নির কাছে মাথাটা খানিক উঁচু হয়ে যায়। জীবনের সঙ্গে তো রয়েছে, কিন্তু ইলিশ হিন্দুদের ধর্মের মধ্য়েও রয়েছে। যেমন জলের দেবতা বরুণের বাহন ইলিশ বলে পুরাণে বর্ণিত রয়েছে। কিন্তু আরও এক লৌকিক দেবতার বাহনও ইলিশ। যিনি কোনওভাবেই বাঙালির সঙ্গে দূর দূরান্তেও সম্পর্কিত নন। বরং তিনি সিন্ধু তীরের দেশ পাকিস্তানের আরাধ্য। যদিও ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে এ দেশেও তাঁর কদর ও ভক্ত রয়েছে। আসুন জেনে নিই তাঁর পরিচয়?
আরও পড়ুনঃ Hilsa Egg: ইলিশের পেটে ডিম আছে কী না, কীভাবে বুঝবেন?
কে সেই দেবতা?
গৌরবর্ণ চেহারা,বুক পর্যন্ত নেমে আসা ধবধবে সাদা দাড়ি। তিনি বিরাজমান রুপালি ইলিশের পিঠে বিছানো পদ্মে। তিনি ঝুলেলাল। পাকিস্তানের সিন্ধুনদের জিন্দাপীর। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবতা,মুসলিমদের কাছে জিন্দাপীর বা দরিয়াপীর। কেউ বলেন শেখ তাহির। তাঁকে নিয়ে প্রচুর লোকসংস্কৃতি চালু আছে। গান থেকে প্রবাদ ঘোরে তাঁকে ঘিরে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিখ্যাত গায়িকা রুণা লায়লার একটি গান তো রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে। 'দমাদম মস্ত কলন্দর, হো লাল মেরি পাত রখিয়ো ভালা ঝুলেলালনা'। এ গানে ঝুলেলালের কাছে কল্যাণ কামনা করা হয়েছে।
এই পীরের আসল নাম কী?
তাঁর নাম আসলে লাল শাহবাজ কলন্দর। সমাধিফলকে স্পষ্ট করে লেখা 'ঝুলেলাল'। প্রতিদিন জাতধর্ম নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ ভিড় জমায় সে দরগায়। ভক্তিভরে তাকে ঝুলেলাল নামেও ডাকেন হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ। কেন তিনি মস্ত কলন্দর আর কেনই বা ঝুলেলাল, সেই ইতিহাস নিয়েও উভয় ধর্মের অনুসারীদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও মিথ। তবে সবার কাছেই তিনি পরম শ্রদ্ধার। অনেকটা বাঙালির লালন ফকিরের মতো। তবে ফকিরের দেবত্ব নেই। ঝুলেলালের আছে।
মুসলিম মতে
বাগদাদের কাছে বাস করতেন হজরত সৈয়্যদ উসমান মারওয়ান্দি ওরফে শাহবাজ কালান্দারের পূর্বপুরুষরা। তিনি হজরত আলির বংশধর। ফকির শাহবাজ পারস্য পাড়ি দিয়ে সিন্ধে আসেন ও ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মত্ততার কারণেই তিনি একজন মস্ত কলন্দর বা উচ্চমার্গের পরিব্রাজক সাধক। আর ঝুলেলাল শব্দটি এসেছে তার বেশ ঢিলেঢালা লাল আলখাল্লার কারণেই। এই তথ্য ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার প্রেস থেকে প্রকাশিত সুফিস অ্যান্ড সেইন্টস বডিস: মিস্টিসিজম, কর্পোরিয়্যালিটি অ্যান্ড সেক্রেড পাওয়ার ইন ইসলাম গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়।
হিন্দু মতে
কিন্তু, শাহবাজ কালান্দারের জন্ম ও পরিচয় নিয়ে কিন্তু সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বিশ্বাস হিন্দুদের। হিন্দুদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় দেবতা তিনি। যার বাহন ইলিশ। তিনি চলাফেরা করেন ইলিশের পিঠে চেপে। অথচ ইলিশপ্রিয় বাঙালির কাছেই মর্যাদা পাননি তিনি। তবে পাকিস্তানের সিন্ধে ইলিশের নাম কিন্তু ইলিশ নয়,সেখানে এর নাম 'পাল্লা'। জিন্দাপীর ওরফে ঝুলেলালকে নিয়ে প্রচলিত আছে তাদের এক অপূর্ব লোককাহিনি। সে কাহিনী পাকিস্তানের সিন্ধকে কেন্দ্র করে। তার সমাধি নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।
সিন্ধুপারের ঝুলেলালের কাহিনী
সিন্ধের শেষ হিন্দু রাজা ছিলেন দাহির সেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। এরপর এটি খলিফা আল ওয়ালিদের খিলাফতের অংশ হয়। দশম শতাব্দীতে সিন্ধ চলে যায় সুমরা রাজবংশের অধীনে। হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়া সুমরা রাজারা ছিলেন উদার ও পরধর্মসহিষ্ণু। কথিত আছে, সুমরা রাজাদের অধীনস্থ থাট্টা প্রদেশের শাসক মিরখশাহ ছিলেন গোঁড়া। ৯৫০ সালে মিরখশাহ ফরমান জারি করেন,থাট্টার হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। নইলে পেতে হবে শাস্তি। তখন হিন্দু গ্রামগুলোর বাসিন্দারা সিন্ধু নদের কাছে গেলে সিন্ধু নদ গ্রামবাসীদের বলে, টানা চল্লিশ দিন ধরে জলদেবতা বরুণ দেবের পুজা করতে। এরপর থাট্টার হিন্দুরা সিন্ধু নদের তীরে শুরু করে বরুণ দেবের পুজা। চল্লিশতম দিন সন্ধ্যায় থাট্টার হিন্দুদের জন্য আসে দৈবাদেশ। সিন্ধু নদ থেকে একটি কণ্ঠ তাদের বলে, দেবকীর গর্ভে জন্ম নিয়ে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
অলৌকিক ঘটনা ঘটে বলে মিথ
তিন মাস পর আশ্বিনের পূর্ণিমায় গর্ভবতী হন রতনচাঁদ লোহানোর স্ত্রী দেবকী। তারপর চৈত্রের পূর্ণিমায় গভীর রাতে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন দেবকী। নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার খানিক পরই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য শিশুটি হাঁ করতেই সবাই অবাক হয়ে দেখে তাঁর মুখের ভেতর বইছে সিন্ধু নদ। আর নদীর জলে ভাসছে একটি অতিকায় ইলিশ। সেই ইলিশের ওপর বসে আছেন এক বরুণ দেব। মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল, মুখে সাদা দাড়ি। মাথায় সোনার মুকুট। তাঁর কোষ্ঠী দেখে এক জ্যোতিষী জানান, ইনি জলদেবতা বরুণের অবতার। তাই তিনি শিশুটির নাম দেন দরিয়ালাল। আরেক এক পাঞ্জাবী জ্যোতিষী তার নাম দেন উদরোলাল। শিশুটির জন্মের কিছুদিন পরেই ঘটে আরেক অলৌকিক ঘটনা। শিশুটির ঝুলা বা দোলনা সারাদিন ধরে নিজে থেকেই দুলত। এ কারণে তার নাম হয়ে যায় ঝুলেলাল। এরপর মিরখশাহ ও তাঁর মন্ত্রীরা নানারকম অলৌকিক ঘটনা নিজেরা প্রত্যক্ষ করেন।
ইলিশই বাহন ঝুলেলালের
সেই ঝুলেলালের বাহন ইলিশ। সিন্ধ অবশ্য ইলিশকে ইলিশ নামে চেনে না, চেনে ‘পাল্লা’ নামে। সিন্ধুর বুড়ো জেলেদের মতে আরব সাগর থেকে মিঠা জলে ঢোকার সময়ে ইলিশের গা থাকে কুচকুচে কালো। উজান বেয়ে যত সে তার ভিতরে এগোয়, তত বাড়তে থাকে তার জেল্লা। আরব সাগর থেকে খানিক উপরে উঠলে হলদে পাথরে ছাওয়া লক্ষ পীরের কবরিস্তান থাট্টা। একটা সময় ছিল, যখন থাট্টার হলুদ পাথরে মাথা ছুঁইয়ে ইলিশের ঝাঁক এগোত উত্তরে। জামশোরো হয়ে সেহওয়ানে শাহবাজ কলন্দরের দরগায় মাতন দেখে উজানে, ঝুলেলালের থানে গিয়ে যখন সে পৌঁছত, ইলিশ বা পাল্লার শরীর তখন রুপোয় মোড়া। এভাবেই দেবতা ঝুলেলালের বাহন হয়েছে হয়তো ইলিশ।
যাই হোক ইলিশপ্রেমী বাঙালির থেকে অনেকটা দূরে সিন্ধু নদের তীরের এই দেবতা ও তাঁর বাহন ঘিরে রহস্য ও মিথ আমাদের রোমাঞ্চিত করে।