পশ্চিমবঙ্গের মত অসমেও চলতি বছরে বিধানসভা নির্বাচন। বর্তমানে এখানে রয়েছে বিজেপি সরকার। উত্তর-পূর্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। তবে সিএএ নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ফলে এখানে যথেষ্টই চাপে রয়েছে গেরুয়া শিবির। উত্তর পূর্বের এই রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে মূল লড়াই কংগ্রেসের। রাজ্যে মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বড় মুখ বদরুদ্দিন আজমল রয়েছেন কংগ্রেসের সঙ্গে। এই আবহে অসম নির্বাচনে কোন ১০টি ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, চলুন তা দেখে নেওয়া যাক।
১.সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (CAA): ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই আইন পাস করে মোদী সরকার। এই আইনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে। ওই দেশের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং পারসি ধর্মের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। তবে এই আইনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের কেন যুক্ত করা হয়নি, তা নিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। এই আইন নিয়ে দ্বিতীয় প্রতিবাদ ছিল যা বিশেষ করে অসমে হয়েছিল, তা হচ্ছে এই ব্যবস্থা তাদের সামাজিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ করবে, এটিকে অসম চুক্তির লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। যাতে পুলিশের গুলিচালায় ৫ বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়। এখন যেহেতু আসামে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, সিএএর বিরুদ্ধেও আওয়াজ উঠছে। এই কারণেই কংগ্রেস সিএএ-কে প্রধান অ্যাজেন্ডা করেছে।
শিবসাগর থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মঞ্চ থেকে বলেছিলেন যে তাঁর দল রাজ্যে ক্ষমতায় এল সিএএ প্রয়োগ করা হবে না। একই সঙ্গে দলের তরফে আরও বলা হয়েছে যে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় প্রাণ হারানো মানুষের একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হবে। কংগ্রেস এই বিষয়টিকে বিশেষ ভাবে উত্থাপন করছে, যদিও বিজেপি একেবারে এড়িয়ে যেতে চাইছে। বাংলায় সিএএ বাস্তবায়নের কথা বললেও অসমে তার উল্লেখ করছেন না বিজেপি নেতারা।
২. জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC): এনআরসি অর্থাৎ সরকারি রেজিস্ট্রারে দেশের বৈধ নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য। আসামে অবৈধ শরণার্থীদের সমস্যা রয়েছে, তাই ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করা হয়েছিল যাতে অবৈধ শরণার্থীদের নাম কাটাতে ভোটার তালিকার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই আবেদনে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালে পুরো অসমে এনআরসি আপডেট করার নির্দেশ দেয়। রেজিস্ট্রার আপডেট করার প্রক্রিয়া শুরু করা হলে, ১৯ লক্ষ হিন্দুর নামও তালিকা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর পরে এনআরসি নিয়ে বিতর্ক হয়। আজও, এই বিষয়টি নিয়ে নবিতর্ক চলছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে যে এনআরসি-তে যাদের নাম নেই তারাও ভোট দিতে পারবেন। কংগ্রেস এবং এইআইডিইউএফ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, যদিও বিজেপি তাতে সন্তুষ্ট নয়।
৩. অবৈধ অভিবাসী: আসামে অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়টি দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে। এই ইস্যুতে, ১৯৮৫ সালে একটি আসাম অ্যাকর্ডও ছিল, যেখানে অবৈধ শরণার্থীদের শনাক্তকরণ এবং অপসারণের দাবিটি ছিল প্রধান। তবে আজও এই সমস্যা রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ আইন নিয়ে এসে দাবি করেছে যে এটি অনুপ্রবেশকারীদের বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে, কিন্তু আসামে এই আইনেরর বিরোধিতা চলছে।
৪. প্রকৃত বাসিন্দাদের জমির অধিকার: অসমে সর্বদা আদি বাসিন্দাদের অধিকার সম্পর্কে একটি আওয়াজ উঠেছে। বিশেষত, দীর্ঘকাল ধরে মূল বাসিন্দাদের জমির অধিকার দেওয়ার দাবি রয়েছে। নির্বাচন এখন যখন শিয়রে, তখন বিজেপি সরকারও এ জাতীয় বাসিন্দাদের জমি ইজারা বরাদ্দ দিচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অসম সফরে গিয়েছিলেন, এই উপলক্ষে ১.6 লক্ষ মানুষকে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছিল। এই সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছিলেন যে জমির আদি বাসিন্দাদের চাহিদা পূরণের পরে তাদের জীবন বদলে যাবে, এখন তারা প্রকল্পগুলির সুবিধা পাবে।
৫. এসটি মর্যাদার দাবি: আসামের কয়েকটি সম্প্রদায়কে তফসিলী উপজাতির মর্যাদা দেওয়ারও দাবি উঠেছে। ছয়টি সম্প্রদায়ের এই স্ট্যাটাস সম্পর্কে আওয়াজ উঠেছে তবে এই চাহিদা এখনও মেটেনি। এসটি মর্যাদার দাবিতে যে ছয়টি সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে তারা হল আহোম, মোরন, মাতাক, কুশ-রাজবংশী, টি-ট্রাইব এবং সুতিয়া। বর্তমান বিজেপি সরকারে এর জন্য একদল মন্ত্রীপরিষঠ গঠন করে, তবে এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৬. লাভ জিহাদ: উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের আরও কয়েকটি রাজ্যে লাভ জিহাদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উত্তরপ্রদেশে ধর্মান্তকরণ বিরোধী আইনও কার্যকর করা হয়েছে। যোগীরাজ্য ছাড়াও মধ্যপ্রদেশ এই আইন এনেছে। অসমে এখন বিজেপি লাভ জিহাদাকে মূল এজেন্ডায় ফেলেছে। রাজ্যে বিজেপির অন্যতম মুখ হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন যে আমরা নিশ্চিত করব, যে ছেলে বিয়ে করছে তার অবশ্যই পরিচয় প্রকাশ করতে হবে এবং এটি সম্পর্কিত বিলটিও বিধানসভায় পাস হবে।
৭. চা: আসামে চা চাষ আয়ের বৃহত্তম উৎস। এখানকার চা দেশ ও বিশ্বে প্রসৃদ্ধ। অতএব, চা অসনে উপার্জনেরৎ উপায়। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তাঁর সমাবেশে চা চাষের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের জন্য আওয়াজ তুলেছেন। তিনি চা শ্রমিকদের আয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে, বিজেপিও চা-কর্মীদের আয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজেপি বলেছে যে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৬৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬৫ টাকা করা হবে।
৮. সাম্প্রদায়িকতা: আসামে বিজেপি এবং তার মিত্ররা একদিকে রয়েছে এবং অন্যদিকে কংগ্রেস বদরুদ্দিন আজমল ও বাম দলগুলির সাথে জোট গঠন করেছে। বদরুদ্দিন আজমল মুসলমানদের বড় মুখ এবং তাঁর দল এআইইউডিএফের অবস্থান অসমে যথেষ্ট শক্তপোক্ত। এমন পরিস্থিতিতে বিজেপি ও এআইইউডিএফ নেতাদের মধ্যে একের পর এক লড়াইয়ের ঘটনা ঘটছে। ধর্ম সম্পর্কিত বিষয় উত্থাপন করা হচ্ছে।
৯. গোর্খা স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিল (GAC): নির্বাচনের পরিবেশের মাঝে গোরখা স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিলের দাবিও উঠে আসছে। অসমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে উপজাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে কাউন্সিল গঠন করা হচ্ছে। এই নির্দেশে তিনটি কাউন্সিল গঠিত হয়েছে, যাদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল, ডিমা-হসাও স্বায়ত্তশাসিত জেলা কাউন্সিল এবং কার্বি স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিল রয়েছে। এই পর্বে গোর্খা স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের দাবিও তোলা হচ্ছে। এ নিয়েও আন্দোলন চলছে।
১০. পেনশন প্রকল্প : রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা নতুন পেনশন প্রকল্পের (NPS) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। কর্মচারীদের দাবি, পুরনো পেনশন স্কিমটি চালানোর অনুমতি দেওয়া উচিত, এজন্য নিয়মিত আন্দোলন করা হচ্ছে।