বহরমপুর এবং অধীর চৌধুরী শব্দদুটো যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিল। পরপর ৫ বার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে সাংসদ হয়েছিলেন তিনি। এবারের ভোটে যে হারবেন তা হয়তো নিজেও বুঝতে পারেননি। সেই কারণে ভোট শেষ হওয়ার পর বেশ খোশ মেজাজেই ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। তবে ভোটের ফলাফল সামনে আসার পর বহরমপুরে ভেঙে গেল অধীর মিথ। দেখা যায়, তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠানের কাছে পরাজিত হয়েছেন তিনি। তাও ৮৫ হাজারেরও বেশি ব্যবধানে।
অথচ এই অধীর চৌধুরীই বহরমপুরে রবিনহুড বলে পরিচিত ছিলেন। জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। গান্ধী পরিবারের বিশেষ করে রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোক ছিলেন। সেজন্য লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতার পদও পান। বহরমপুরের সাংসদ হওয়ার সুবাদে নিজের লোকসভা কেন্দ্রের সমস্যার কথাও তুলে ধরতেন বহরমপুরের 'বেতাজ বাদশা'। তারপরও কেন হেরে গেলেন? সেই গুজরাত থেকে আসা ইউসুফ পাঠান কীভাবে পরাজিত করলেন বহরমপুরের ভূমিপুত্রকে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বহরমপুরে অধীরের হারের কারণ ৫ টি।
প্রথমত : রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সাংগঠনিক দুর্বলতা অধীরের হারের অন্যতম কারণ। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুর্শিদাবাদে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে থাকে রাজ্যের শাসকদল। কংগ্রেসের ঘর ভাঙতে শুরু করে। একের পর এক কংগ্রেস নেতা-বিধায়ক যোগ দেন তৃণমূলে। ফলে বহরমপুরে ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে অধীর। তিনিও ততদিনে দিল্লি কেন্দ্রীক রাজনীতির আবর্তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বহরমপুরের ভূমিপুত্র হলেও দিল্লিতেই বেশিরভাগ সময় থাকতে হত তাঁকে। ফলে তাঁর চোখের আড়ালে একের পর এক কংগ্রেস নেতা ঘাসফুল শিবিরে যোগ দেয়। অধীরের রক্তক্ষরণ সেই থেকেই। তবে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে অধীরের উপর তার প্রভাব না পড়লেও ২০১৯ থেকে তিনি সাংগঠনিক দুর্বলতার অবস্থা টের পেতে শুরু করেন।
দ্বিতীয়ত : ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বহরমপুর লোকসভার ৭ বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের ভোটের ফলাফলের মধ্যে অধীরের হারের বিজ নিহিত বলে দাবী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। কারণ, একুশের ভোটে বড়ঞা, কান্দি, ভরতপুর, রেজিনগর, বেলডাঙা, বহরমপুর ও নওদা এই ৭ আসনের মধ্য়ে একটিও দখল করতে পারেনি কংগ্রেস। বহরমপুর আসনটি দখল করে বিজেপি। সেখানে ভোট শতাংশের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে তারা। ৬ টি আসন দখল করে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। তারা প্রথম স্থানে শেষ করে। কংগ্রেস অপ্রত্যাশিতভাবে তৃতীয় স্থানে থেকে নির্বাচন শেষ করে। অর্থাৎ ওই ৭ বিধানসভা কেন্দ্রের একটিতেও কংগ্রেসের বিধায়ক ছিল না। তাতে কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত : বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির উত্থান অধীরের ভোটে হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে দাবি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বহরমপুর লোকসভা আসন থেকে বিজেপি পায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ভোট। তবে ২০২৪ সালের ভোটে বিজেপি প্রার্থী নির্মল সাহা দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পান। তাঁর এবার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৩ লাখ ৭১ হাজারেরও বেশি। বিজেপির এই ভোট অধীরের ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলে।
চতুর্থত : ভোটের ধর্মীয় মেরুকরণও অধীরের হারের অন্যতম কারণ বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। অধীর নিজেও তা স্বীকার করেছেন। হারের কারণ হিসেবে তিনি জানান, 'আমি না হতে পেরেছি হিন্দু, না মুসলিম। আমি দুইয়ের মাঝে পড়ে স্য়ান্ডউইচ হয়েছি।' অথচ ভোটের আগে অধীর দাবী করেছিলেন, তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের মানুষ ধর্ম দেখে ভোট দেবেন না। বাস্তবে যদিও তা হয়নি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ ওই বহরমপুর কেন্দ্রে মুসলিম ভোটের বেশিরভাগই পেয়েছেন ইউসুফ। বেশিরভাগ হিন্দু ভোট পেয়েছেন বিজেপির প্রার্থী নির্মল কুমার সাহা। ফলে বড়সড় ভোট ব্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অধীরের। তিনি যে ভোট পেয়েছেন তা কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদেরই।
পঞ্চমত : অধীরের হারের অন্যতম কারণ হল ইউসুফ পাঠানের জনপ্রিয়তা। তৃণমূল কংগ্রেস বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ইউসুফকে প্রার্থী করে। তিনি ব্যাপক সাড়াও পান। ইউসুফ রাজনৈতিক ব্যক্তি না হলেও তাঁর জনপ্রিয়তাকে প্রচারের কাজে লাগায় তৃণমূল কংগ্রেস। তার ফলাফলও মেলে।
অধীরের হারের ফলে একটা যুগেরও অবসান হল বলে দাবি করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, সোমেন মিত্র, মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় (যখন কংগ্রেস করতেন), প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, গনি খান চৌধুরী, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পর অধীর চৌধুরী ছিলেন গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ। ইউপিএ সরকারের আমলা তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। তবে অধীর হেরে যাওয়ার ফলে গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ তেমন বাঙালি নেতা আর থাকল না বললেই চলে।
১৯৯১ সালে নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অধীর চৌধুরী। সেবার খুব অল্প ভোটে হেরে যান। তবে ১৯৯৬ সালে ওই আসন থেকে জেতেন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি বহরমপুর লোকসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই আসন থেকেই টানা ৫ বার জেতেন তিনি। প্রথমবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন ২০১৪ সালে।