scorecardresearch
 

Exclusive: রাজনীতিতে কোন ভাষা শিষ্টাচার বিরুদ্ধ? বিশ্লেষণে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়

নির্বাচনী আবহে অনেক বদলে যাওয়া পরিস্থিতির মধ্যে একটি হল, ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন। তা সে রাজনৈতিক নেতা, সমর্থক থেকে নেটিজেন, সকলের মধ্যেই চোখে পড়ছে। কতটা প্রভাব পড়ছে সমাজে এর? আলোচনা করলেন মনোবিদ ডাঃ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় (Dr. Anuttama Banerjee)।

Advertisement
ডাঃ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাঃ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
হাইলাইটস
  • পশ্চিমবাংলায় কার্যত নির্বাচনী বাতাবরণ।
  • ভোটের আবহে ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তনও নজরে পড়ছে অনেকের।
  • সমাজে কী প্রভাব ফেলছে এটি? আলোচনা করলেন ডাঃ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়।

পশ্চিমবাংলায় কার্যত 'ভোট উৎসবে' (Bengal Election 2021) মেতে উঠেছেন সকলে। চায়ের দোকান থেকে অফিসের ক্যান্টিন, সবেতেই এখন আলোচনার মূল বিষয়বস্তু , নির্বাচন। কোনও দলই অপর পক্ষকে এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে নারাজ। প্রতিদিনই চলছে রাজনৈতিক তরজা। 

নির্বাচনী আবহে অনেক বদলে যাওয়া পরিস্থিতির মধ্যে একটি হল, ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন। তা সে রাজনৈতিক নেতা, সমর্থক থেকে নেটিজেন, সকলের মধ্যেই চোখে পড়ছে। কতটা প্রভাব পড়ছে সমাজে এর? আলোচনা করলেন মনোবিদ ডাঃ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় (Dr. Anuttama Banerjee)

প্রশ্ন: নির্বাচনী বাতাবরণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমানে যে সব শব্দ চয়ন করছেন তা নিয়ে এখন সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টা?

মনোবিদ: যে ভাষাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কিন্তু আমরা কোনও মতাদর্শের লড়াইয়ের ছবি দেখছি না। আমরা কিছু এমন ব্যক্তি আক্রমণের ভাষা শুনছি, যেখানে শুধু সেই মানুষটিরই অপমান করা হচ্ছে না, তাঁকে অপমান করার মধ্য দিয়ে সমষ্টিকেও অপমান করা হচ্ছে। 

 

প্রশ্ন: কী রকম? 

মনোবিদ: নারীদের অপমান করা হচ্ছে, নারীদের পোশাক নিয়ে বক্রোক্তি করা হচ্ছে। এমনকি অনেক সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেও অপমান করা হচ্ছে। আবার কখনও দেখছি কোনও হয়তো কোনও মানসিক রোগীদের অপমান করা হচ্ছে। তাঁরা হয়তো না জেনেই করছেন। 

 

প্রশ্ন: এটা থেকে কী সমাজে ভাষা দূষণ হচ্ছে বলা যায়?

মনোবিদ: আমার মনে হয় এই জায়গাটাতে আমাদের আরও অনেক বেশি সচেতন হওয়া দরকার। কারণ জনমানসে এই জন প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে একটা উচ্চ ধারনা এর ফলে তৈরি হওয়ার কথা নয়। অনেক সময়ে আমরা দেখি কে কত বেশি খারাপ ভাষা বলতে পারেন, যেন সত্যি ভাষার দূষণেরও একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে অনেকের মনে হতে পারে, কে কম খারাপ বা কে আমার পক্ষে কম ক্ষতিকারক তাঁকেই নির্বাচনে আমি ভোট দেব। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কে কম খারাপ ভেবে ভোট দেওয়াটা কিন্তু এমনিতেও খুব হতাশা ব্যঞ্জক। 

Advertisement

 

প্রশ্ন: বিভিন্ন সাক্ষাৎকার তো বাচ্চারাও দেখছে। এটার প্রভাব তাঁদের অপর কতটা পড়ছে?

মনোবিদ: এই নির্বাচনী খবর ইত্যাদির মাধ্যমে এই বয়সেই বাচ্চারা এমন অনেক ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো তাদের জানার কথা না। যখন সেই বাচ্চাকেই আমরা পরস্পরের প্রতি এই ভাষা ব্যবহার করতে শুনবো, তখন আমরাই হয়তো শিউরে উঠবো, যে তুমি এসব কী বলছো? কিন্তু বাচ্চারা তো আমাদেরই প্রতিফলক। আমরা অভিভাবক হিসাবে যেই ভাষা ব্যবহার করবো, তারা তো সেটাই শিখবে। তাদের মাথায় চলবে, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যদি একজন এই ভাষায় কথা বলতে পারেন, তাহলে আমি পারবো না কেন? তাহলে আমি স্কুলে এক বন্ধুর সঙ্গে রাগারাগি হলে এটাই প্রয়োগ করতে পারি...

 

প্রশ্ন: এটা কি এড়ানো সম্ভব ছিল?

মনোবিদ: আমার মনে হয় যেটা কাঙ্খিত ছিল তা হল একটা ইস্যু নির্ভর দ্বন্দ্ব। যেখানে একটা দল অন্য একটি দলের মতাদর্শ বা বিভিন্ন ইস্যু ধরে সমালোচনা করবে। কিন্তু আমরা যে পরিমাণ কদর্য ভাষার ব্যক্তি আক্রমণ এবং সমষ্টি আক্রমণ দেখছি তাতে কিন্তু আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা চলে যাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হচ্ছে।

 

প্রশ্ন: অনেক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর আক্রমণে 'বডি শেমিং'-র প্রসঙ্গও উঠে আসছে। যেখানে একদিকে এই বিষয় নিয়ে এতটা সচেতন বার্তা দেওয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কী বার্তা বহন করছে এটি?

মনোবিদ: শুধু বডি শেমিং বা একজন মানুষের আকৃতি নিয়েই যে কটুকথা বলা হচ্ছে এমন নয়। আমরা শুনছি কেউ কখনও কাউকে চ্যাংড়া বলছেন, কেউ কখনও বলছেন উনি অবিবাহিত ননদ, কেউ কখনও আবার বলছেন ওঁর তো মাথার ঠিক নেই, ও পাগল, কেউ কখনও কাউকে ভিখারি বলছেন। হয়তো তিনি একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক বিরোধিতাই করার জন্য একথা বলছেন, কিন্তু সেই বিরোধিতার ভাষা এমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, তা শুধু একজনের ওপর সীমাবদ্ধ থাকছে না। সেটা আরও অনেক মানুষকে বিঁধছে। আরও অনেক মানুষকে অপমান করছে। আমরা যখন সত্যিই কাউকে ভিখারি বলি, তখন তো এমন অনেক দরিদ্র মানুষকে অপমান করা হয় যাঁদের দারিদ্রের দায়ে কোথাও না কোথাও আমাদের ওপর এসেও বর্তায়। তার কারণ তাঁদের অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দায়িত্বও ছিল। বহুক্ষেত্রেই যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির ক্ষেত্রে তা রাজনৈতিকভাবে অশুদ্ধ। 

 

 প্রশ্ন: বর্তমানে এত ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে, সেটা ভবিষ্যৎকে কতটা অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

 মনোবিদ: ভবিষ্যৎ তো অনেক দূরের কথা, এই মুহূর্তে গোটা বিষয়টাই অবক্ষয়ের জায়াগাতেই রয়েছে। অনেক সময়ে আমরা দেখছি কাউকে খুব ব্যঙ্গ করে কথা বলার মধ্য দিয়ে যে ধরনের উক্তি হচ্ছে, তাতে কিন্তু সেই ব্যঙ্গ আদতে খুব অপমানজনক, অসংবেদনশীল এবং অসহিষ্ণুতার একটা বাতাবরণ তৈরি করছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, আমি একজনকে তো 'উনি মিথ্যাচার করছেন' বলতে পারি, 'উনি ঢপবাজি করছেন' না বলে। কাউকে 'তোলাবাজ' না বলে তো 'উনি অসৎ উপায় টাকা অর্জন করছেন' বলতে পারি। কোথায় আমি কী শব্দ প্রয়োগ করবো এবং কীভাবে সেটা ব্যবহার করবো সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। 

 

 প্রশ্ন: কোন দল কিছুটা মন্দের ভাল এই দিকে? 

মনোবিদ: আমি কোনও দলকেই এই মুহূর্তে একেবারে ক্লিনচিট দিতে পারছি না। এখানে কোনও ব্যক্তি বা দলের বিপরীতে শুধু অভিযোগ না, এখানে সম্পূর্ণ বিষয়টায় সমস্যা। দুর্ভাগ্যবশত এই মুহূর্তে এরকম কোনও দলের কথা আমার মনে পড়ছে না, যে এটার কোনও কলঙ্কিত অধ্যায় বহন করছে না। 

Advertisement

 

 প্রশ্ন: একজন ব্যক্তির অপর আরেকজনের প্রতি কতটা ঘৃণা জন্মাচ্ছে এর ফলে?

মনোবিদ: এমনিতেই এখন একটা রাজনৈতিক পরিবেশ রয়েছে চারিদিকে। এমনকি আমাদের আলোচনার মধ্যে কে কোন দলকে সমর্থন করেন, এটাই চলছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই নিয়ে দেখছি অনেক চাপানউতোর। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, আমার সঙ্গে আমার বন্ধুর রাজনৈতিক মতাদর্শের ফারাক থাকতেই পারে, কিন্তু আমি যখন তার সঙ্গেও সেটা নিয়ে তর্কে আসছি, সেই মুহূর্তেও ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত থাকাতেই আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটার সূত্র ধরে, আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতেও সাংঘাতিক ব্যক্তি আক্রমণ দেখছি। আমরা বহু সময়ে দেখছি, একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই কী পরিমাণ ট্রোলিংয়ের স্বীকার হচ্ছেন প্রত্যেকটি মানুষ। আমরা ভিন্ন মতের প্রতি ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। এমনকি তাঁরা হয়তো রাজনৈতিক কেউ নন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কোনও সংবাদমাধ্যমের খবরের নিচের কমেন্ট সেকশন দেখলেও তা বোঝা যাবে। সেখানে দল -ব্যক্তি নির্বিশেষে যে নোংরা ভাষায় লেখা হচ্ছে তা মুখে আনার মতো না। বর্তমানে ভাষার নোংরামিটাই যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে।    

 

প্রশ্ন:  তাহলে কি এটাকে একটা সামাজিক ব্যাধি বলা যায়? 

মনোবিদ: না! আমি 'ব্যাধি' শব্দটাই বলবো না। কারণ সেখানে যে মানুষটি এই কাজটি করছেন তাঁর হাতে যেন বিষয়টি ছিল না এরকম বোঝায়। ব্যাধি তো কেউ ইচ্ছে করে বাধায় না। এটা কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তাই সহজে দায়িত্ব এড়ানো যাবে না। বরং আমি বলবো এটা আমাদের এক ধরনের সামাজিক আচরণ, যে আচরণের মধ্যে আমাদের অসম্ভব অসংবেদনশীল, অসহিষ্ণুতা এবং হিংস্রতার একটা বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখছি। যেখানে রাজনীতিবীদ থেকে আরম্ভ করে, সাধারণ মানুষ সবাই একই রকম আচরণ করছেন। আমাদের সকলকে সমদায়িত্ব নিতে হবে। 

 

প্রশ্ন: কীভাবে সম্ভব সেটা?

মনোবিদ: করাটা হয়তো কঠিন। কিন্তু কেউ যখন এরকম কোনও কটুকথা তাঁর ভাষণে বলবেন, আমরা হাততালি দেব না। আমারাও কি তাঁদের একটা সিগনাল দিতে পারি না, যে আপনি এই ভাষায় কথা বললে আমরা শুনবো না? তাঁরাও যদি দেখেন যে সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন না, তাঁরাও তাঁদের ভাষণ হয়তো বদলাবেন একটা সময়ে। কারণ আমাদেরই তো মন জেতার জন্য এত কিছু তোড়জোড়। আমাদেরও একটা সামগ্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ভাষা নির্মাণ করতে হবে। জনসাধারণের যেমন একটা ভূমিকার কথা উল্লেখ করলাম, রাজনীতিবিদদের কাছেও আমার আবেদন থাকবে তাঁরাও যেন পরস্পরের মতাদর্শের লড়াইতে লিপ্ত হতে গিয়ে এই হুমকির ভাষা, অসম্মানের ভাষা, পারস্পরিক বিদ্রুপ- বিদ্বেষের ভাষা থেকে সরে আসেন।      

 

Advertisement