ছৌ নাচের রঙীন বাহার হোক অথবা লাল পলাশের রঙে আগুন ধরা রূপ, পর্যটকদের কাছে পুরুলিয়া অন্যতম আকর্ষণ। গ্রীষ্ণের দাপুটে গরমে যেমন টেকা দায়, তেমনি শীতকালে এই জেলার মনোরম পরিবেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করবে না। আর বসন্তের সময় পুরুলিয়ার রূপ হয় একেবারে অন্যরকম। লাল পলাশে ছেয়ে যায় গোটা জেলা, আগুনে রূপের বাহার দেখতে পুরুলিয়ায় হাজির হন পর্যটকের দল। তবে শুধু পলাশ কেন, ড্যাম, নদী ও পাহাডে ঘেরা পুরুলিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে মুখ ফেরানো যাবে না। আদিবাসী ও তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এই পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন হতে চলেছে ২৫ মে। দেখে নেওয়া যাক এক নজরে এই কেন্দ্রটিকে।
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্র
পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ৪২ টি লোকসভা কেন্দ্রের একটি এবং ১৯৫৭ সালের লোকসভা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি তফসিলী জাতি ও তফসিলী উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত নয় এবং মোট সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। এই জেলায় ষষ্ঠ দফায় নির্বাচন হতে চলেছে ২৫ মে। লোকসভা কেন্দ্রটি ৭ টি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। এগুলি হল- বলরামপুর, বাঘমুন্ডি, জয়পুর, পুরুলিয়া, মনবাজার (এসটি), কাশীপুর ও পারা (এসসি)।
চব্বিশের লোকসভা ভোট
এবারের লোকসভা নির্বাচনে কুড়মি সমাজ আলাদা করে ভোটে লড়াইয়েই ঘোষণা করে দিয়েছে। আদিবাসী কুড়মি সমাজের মুখ্য উপদেষ্টা অজিত প্রসাদ মাহাতোকে পুরুলিয়া থেকে প্রার্থী করেছে আদিবাসী কুড়মি সমাজ। এবারের লোকসভা নির্বাচনে পুরুলিয়ায় মূলত দ্বিমুখী লড়াই। তৃণমূল বনাম বিজেপি। তৃণমূল প্রার্থী করেছে শান্তিরাম মাহাতোকে। বিজেপির থেকে পুরুলিয়ায় ফের একবার ভোটে লড়ছেন বিদায়ি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো।
মোট ভোটদাতা
পুরুলিয়াতে মোট ভোটদাতার সংখ্যা হল ১৬,৪৫,৮৮৪। ২০১৯ সালে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৩,৫৫,২৩৬। ২০১৯ সালে মোট ৮২.৩৪% শতাংশ ভোট গৃহিত হয়েছিল।
বিজেপির দখলে পুরুলিয়া
পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভায় একুশের বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের জয়জয়কার ছিল বেশি। সাতটির মধ্যে পাঁচটি কেন্দ্রেই বিজেপি পদ্মফুল ফুটিয়ে ছিল। বলরামপুর, জয়পুর, পুরুলিয়া, কাশিপুর ও পারাতে বিজেপি আসন দখল করে। শুধুমাত্র বাঘমুণ্ডি ও মানবাজার ছিল তৃণমূলের দখলে। অপরদিকে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও এই পুরুলিয়া থেকেই জয় পান বিজেপির জ্যোতির্ময় মাহাতো। তিনি ৬,৬৮,১০৭ ভোটে বিএসপির আনন্দী টুডুকে পরাস্ত করেন। তবে এই বছর এই কেন্দ্রে বিজেপি বনাম তৃণমূলের জবরদস্ত লড়াই হতে চলেছে।
পুরুলিয়ায় এককালে শোনা শেত বামেদের হুঙ্কার
বাম জমানায় এই পুরুলিয়া ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি। বামফ্রন্টের শরিক দল ফরওয়ার্ড ব্লকই বরাবর প্রার্থী দিয়েছে এখানে। সেই ১৯৭৭ সাল থেকে এখানে জিতছে ফরওয়ার্ড ব্লক। টানা দশবার লোকসভা ভোটে সিংহ প্রার্থীর উপরেই ভরসা রেখেছিল পুরুলিয়া। এমনকী ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যখন গোটা বাংলায় বাম-বিরোধী হাওয়া, তখনও পুরুলিয়ার শক্ত ঘাঁটি নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। কিন্তু খেলা ঘুরে যায় এরপরে। ২০১৪ সালে ফরওয়ার্ড ব্লককে হঠিয়ে দিয়ে পুরুলিয়ায় প্রথমবার জয় পায় তৃণমূল। কিন্তু সেই জয়ের আনন্দের স্থায়িত্ব ছিল ওই একটা টার্মেই। ২০১৯ সালেই আবার মোদী ম্যাজিকে ভর করে পুরুলিয়ায় গেরুয়া ধ্বজা ওড়ায় বিজেপি।
২০১৪ সালে প্রথম জয় তৃণমূলের
২০০৯ সালেও যখন গোটা রাজ্য জুড়ে তৃণমূল সবুজ আবীর ওড়াচ্ছে, তখনও এই কেন্দ্রটি দখল করে রেখেছিল বামেরাই। সেই সময়ে লোকসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া থেকে বামেদের প্রার্থী হন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরহরি মাহাতো। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সেই হাওয়ার মধ্যেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিলেন নরহরি। পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৯৯ হাজার ভোট। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আর এই পুরুলিয়ার দুর্গ ধরে রাখতে পারেনি বামেরা। এবারও পুরুলিয়া থেকে বামেরা ভরসা রেখেছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের নরহরি মাহাতোর উপর। কিন্তু তাঁকে পরাস্ত করে পুরুলিয়া থেকে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো। তিনি পেয়েছিলেন ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট।
পাঁচ বছরেই হাওয়া বদল পুরুলিয়ায়
২০১৪ সালে প্রথমবার তৃণমূল দখল নেয় পুরুলিয়ার। কিন্তু সে হাসি বেশিদিন টেকেনি। ২০১৯ সালের লোকসভা জ্যোতির্ময় সিং মাহাতোর হাত ধরে রেকর্ড তৈরি করে বিজেপি। পদ্ম প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো পান সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি ভোট। ৬ লাখ ৬৮ হাজার। ভোট শতাংশ গত লোকসভার তুলনায় ৪২ শতাংশ বেড়ে যায়। ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্তি ক্রমশ কমতে কমতে একেবারে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গিয়েছে ভোট রাজনীতিতে। উনিশের ভোটে পুরুলিয়া থেকে চার বারের প্রাক্তন সাংসদ বীর সিং মাহাতোকে দাঁড় করিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। কিন্তু চতুর্থ স্থানে ভোটের লড়াই শেষ করেন তিনি। পান ৬৮ হাজারের কিছু বেশি ভোট।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বনাম তৃণমূল
এই বছরও কি বিজেপি পুরুলিয়ায় তাঁদের গেরুয়া পতাকা ওড়াতে পারবে? ২০১৯ সালের লোকসভায় বিজেপি যে গতিতে উত্থান দেখিয়েছে, এই বছর তা আরও বাড়াতে সংকল্পবদ্ধ পদ্ম শিবির। অপরদিকে তৃণমূলও তৈরি ফের পুরুলিয়ার দখল নিতে। ফের একবার মুখোমুখি লড়াইয়ে নামছে তৃণমূল ও বিজেপি। বিজেপি কি পারবে তৃণমূলকে হারিয়ে গেরুয়া শিবির ধরে রাখতে নাকি তৃণমূল তাদের সবুজ পতাকা ওড়াতে সক্ষম হবে? আপাতত সেই দিকেই নজর রাজনৈতিক মহলের।