scorecardresearch
 

লাল দুর্গে বিধি বাম, স্বাধীনতা থেকে বর্তমান, কোন পথে রঙ পরিবর্তন নন্দীগ্রামের

১৯৫২ সালে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্ব কংগ্রেসের জয়জয়কার দেখা গিয়েছিল বাংলা জুড়ে। সেবার নন্দীগ্রামেও উড়েছিল হাত শিবিরের পতাকা। ১৯৬৭ সালে প্রথমবার সরকারে আসে বামেদের ইউনাইটেড ফ্রন্ট। পায় মোট ১৩৩টি আসন। যার মধ্যে ছিল নন্দীগ্রাম আসনটিও। সেই নন্দীগ্রাম গত এক দশক ধরে রয়েছে তৃণমূলের দখলে। পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে নন্দীগ্রামের মানুষের মন ফের একবার বদলাতে শুরু করেছে।

Advertisement
স্বাধীনতার পর একাধিকবার রঙবদল হয়েছে নন্দীগ্রামের স্বাধীনতার পর একাধিকবার রঙবদল হয়েছে নন্দীগ্রামের
হাইলাইটস
  • পূর্ব মেদিনীপুরের ছোট্ট একটি জনপদ আজ রাজ্য রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে
  • স্বাধীনতার পর একাধিকবার রঙবদল হয়েছে নন্দীগ্রামের
  • এবার ফের একবার সেই বদলে সামিল হবেন নাকি নন্দীগ্রামবাসী?

এবারের ভোটে সবথেকে হাইভোল্টেজ বিধানসভা কেন্দ্র বলতে গেলে নন্দীগ্রাম । তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং লড়ছেন নন্দীগ্রাম থেকে । আর তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী আবার একসময়ের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত শুভেন্দু অভিধারী। দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতির ময়দানে কাটান মমতা ও শুভেন্দু  কিন্তু খুব ভাল করেই জানেন একে অপরের দুর্বলতা ও শক্তির কথা। পয়লা এপ্রিল নন্দীগ্রামে ভোট। ইতিমধ্যেই মনোনয়ন পেশ করে ফেলেছেন হাইভোল্টেজ দুই প্রার্থী। ভোটবঙ্গে এখন লাইম লাইটে প্রাক্তন দুই সহযোগীর সম্মুখ সমর। তবে সম্মানের লড়াইয়ে কে জিতলেন তা জানতে আপাতত ২ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে স্বাধীনতার পর থেকে রঙ বদলেছে নন্দীগ্রামের। কংগ্রেস থেকে বাম হয়ে তৃণমূলের জয়জয়কার দেখেছে পূর্ব মেদিনীপুরের এই জনপদ। ফের একবার সেই রঙবদলে সামিল হবে নাকি নন্দীগ্রাম তা সময় বলবে। এখন দেখে নেওয়া যাক স্বাধীনতার পর থেকে কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে বর্তমানে বঙ্গ রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা নন্দীগ্রামের।

স্বাধীনতার পর হাতেই ছিল ভরসা
১৯৫২ সালে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্ব কংগ্রেসের জয়জয়কার দেখা গিয়েছিল বাংলা জুড়ে। সেবার নন্দীগ্রামেও উড়েছিল হাত শিবিরের পতাকা। তখন নন্দীগ্রাম ছিল দুটি বিধানসভা কেন্দ্র। নন্দীগ্রাম উত্তর থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন সুবোধ চন্দ্র মাইতি আর নন্দীগ্রাম দক্ষিণে কংগ্রেসের টিকিটে জেতেন প্রবীর চন্দ্র জানা। ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালেও নিজেদের গড় ধরে রেখেছিল কংগ্রেস। ১৯৬৭ সালে দুটি বিধানসভার বদলে নন্দীগ্রাম একটি বিধানসভা আসনে পরিণত হয়। আর সেবার থেকেই বামেদের জয়জয়কার শুরু হয় এখানে।

Nandigram Divas: ঐতিহাসিক ১৪ মার্চ, ফিরে দেখা সেই ইতিহাস যা বদলে দেয় বাংলার রাজ্যপাট

চতুর্থ বিধানসভা থেকে নন্দীগ্রামের দখলে বামেরা
১৯৬৭ সালে প্রথমবার  সরকারে আসে বামেদের ইউনাইটেড ফ্রন্ট। পায় মোট ১৩৩টি আসন। যার মধ্যে ছিল নন্দীগ্রাম আসনটিও। বিজয়ী হন ভূপালচন্দ্র পণ্ডা। ১৯৬৯, ১৯৭১,১৯৭২ পরপর চারটি নির্বাচনের নন্দীগ্রাম থেকে জয়ী হয়েছিলেন সিপিআই-এর ভূপালবাবু। ১৯৭৭ সালে অবশ্য প্রবল বাম হাওয়ার মাঝেই জনতা পার্টি জেতে নন্দীগ্রাম থেকে। এরপর ১৯৮২, ১৯৮৭ ও ১৯৯১ আবার বামেদের দখলেই চলে যায় নন্দীগ্রান। ১৯৯৬ সালে ফের একবার কংগ্রেস প্রার্থীকে বেছে নেয় এই বিধানসভার মানুষ। তারপর ২০০১ এবং ২০০৬ সালে বামেদের প্রত্যাবর্তন। কিন্তু তারপর? তারপরই বদলে যেতে থাকে পুরো চিত্র। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে নিজের পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে হয় বিধায়ক ইলিয়াস মহম্মদকে শেখকে। তারপর পরপর ৩ বারের নির্বাচনে আর তেমন ভাবে নন্দীগ্রামে পাওয়া যায়নি বামেদের অস্তিত্ব।

Advertisement

প্রথম ভোটেই 'জায়ান্ট কিলার' হয়েছিলেন মমতা! এবার সুযোগ মীনাক্ষির সামনেও

নন্দীগ্রামের মাটিতে ঘাসফুলের আধিপত্য
বাংলার রাজনীতির সঙ্গে যে শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটি হল নন্দীগ্রাম। এখানেই জমি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার রচিত হয়েছিল পরিবর্তনের ব্লুপ্রিন্ট, এককথায় বলা যায়, সিঙ্গুর আন্দোলনের পর ব্যাকফুটে চলে যাওয়া তৎকালীন বাম সরকারে কফিনে নন্দীগ্রাম আন্দোলনই শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের। ২০০৭ এর ১৪ মার্চ, নন্দীগ্রামে জমি বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর দেশ জুড়ে ঝড় ওঠে। স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে নন্দীগ্রামের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। এরপরেই ২০১১-এ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটে এবং ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগেই অবশ্য ঘাসফুলের দিকে ঝুকে পড়েছিল নন্দীগ্রাম। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিধায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়  ইলিয়াস মহম্মদ শেখকে। এরপর ২০০৯-এর উপ নির্বাচনে জয়লাভ করেন তৃণমূলের প্রার্থী ফিরোজা বিবি। সেই থেকেই ঘাসফুলের জয়জয়কার চলছে। ২০১১ সালের পরিবর্তনের সময়  নন্দীগ্রামে জয় হয় ঘাসফুল শিবিরেরই। এরপর ২০১৬ বিধানসভায় এই আসনে যেতেন শুভেন্দু অধিকারী। এবার লড়াইটা যে মূলত বিজেপি শিবিরে যাওয়া শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর প্রাক্তন দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস্টিজ ইস্যু তা সবাই জানেন। 

মমতার রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল নন্দীগ্রাম
মমতার রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল নন্দীগ্রাম

ভোট শতাংশ কী বলছে?
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম বিধানসভায় জয়ী হয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাসফুল চিহ্নে দাঁড়ানো শুভেন্দু- রেকর্ড ভোটে জয় পেয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রার্থী সিপিআই-এর আব্দুল কবির শেখের থেকে তাঁর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল ৮১,২৩০। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে সিপিআই-এর ঝুলিতে এসেছিল ২৭ শতাংশ ভোট।  ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামের লোকসভা আসন তমলুক থেকেও তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন শুভেন্দু-র ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় সেবার বামেদের বদলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিলেন  বিজেপি প্রার্থী সিদ্ধার্থশঙ্কর নস্কর। সেবার  দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপি পেয়েছিল ৬২,২৬৮ ভোট।  তিন নম্বর স্থানে সিপিআই প্রার্থীর বরাতে জোটে ৯,৩৫৩ ভোট। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস নন্দীগ্রাম বিধানসভায় পেয়েছিল ৬৩.১৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন। বিজেপি পেয়েছিল ৩০.০৯ শতাংশ মানুষের ভোট। নন্দীগ্রামে বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ৩৩ শতাংশ মুসলিম ভোটার। এরমধ্যে নন্দীগ্রাম ১-এ ৩৫ শতাংশ, নন্দীগ্রাম ২-এ ১২-১৪ শতাংশ মুসলিম। এই ভোট এবারের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।

ঘরের ছেলে সফল হবেন?
ঘরের ছেলে সফল হবেন?

তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হোল, নন্দীগ্রামেই ১০ বছর আগে বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ১.৭২ শতাংশ ভোট। তৃণমূল পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৬১.২১ শতাংশ ভোট। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা আরও বেড়ে ৬৭.২০ শতাংশ হয়। বিজেপি পায় ৫.৪০ শতাংশ ভোট। সেখানে ৩ বছরেরর মধ্যে লোকসভা ভোটে প্রায় ২৫ শাতংশ ভোট বাড়িয়ে নেয় গেরুয়া শিবির। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের জমি রক্ষা আন্দোলন রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে সেখানে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে তৃণমূল। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি ঘাসফুল শিবিরকে। ২০১১ সালে নন্দীগ্রামের বিধায়ক হয়েছিলেন শহিদ জননী ফিরোজা বিবি। ২০১৪ সালে তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হন শুভেন্দু অধিকারী। ২০১৬ সালে নন্দীগ্রামের বিধায়ক নির্বাচিত হন শুভেন্দু। ওই বছরেই তমলুক লোকসভার উপ-নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার লিড পেয়েছিলেন দিব্যেন্দু অধিকারী। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে তৃণমূলের লিড কমে হয় প্রায় সাড়ে ৬৮ হাজার। আর বিজেপি-র ভোট ২০১৬ সালে যেখানে ছিল ১০ হাজারের কিছু বেশি, তা ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ৬২ হাজারের বেশি। এই পরিসংখ্যান বলছে, ভোট কমেছে তৃণমূলের, বেড়েছে বিজেপি-র। বামেদের ভোটও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। রাজ্য রাজনীতির পালাবদলের সূচনা হয়েছিল যে মাটি থেকে, সেই নন্দীগ্রামই গত এক দশক ধরে দেখেছে শাসকদলের দলাদলি। প্রায় বিরোধীশূন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে তৃণমূলের প্রতিপক্ষ হিসেবে তাই মাথা তুলছে গেরুয়া শিবির। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির জেরে জেরবার নন্দীগ্রামবাসী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সেই ক্ষোভেই অনেকে বিজেপি-র দিকে ঝুঁকছেন। আমফান ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিস্তর গরমিলের অভিযোগ উঠেছে নন্দীগ্রামের তৃণমূল জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও। দল বদলরে পর সেই অভিযোগ স্বয়ং করেছেন শুভেন্দু অধিকারীও। এই আবহে ২০২১ সালে নন্দীগ্রাম ফের রঙ বদলায় কিনা তা জানতে দোসরা মে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। 

Advertisement


 

Advertisement